ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খাগড়াছড়িসহ কয়েকটি জেলায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার দাবিতে বিএনপির মানববন্ধন কর্মসূচিতে পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ ও আটকের ঘটনা ঘটেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশ জেলা বিএনপির গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আলী আজম ও জেলা শ্রমিক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মোস্তফাকে আটক করেছে। খাগড়াছড়িতে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে ১০ নেতাকর্মী ও পাঁচ পুলিশ আহত হয়েছে। এদিকে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করতে জোর কূটনৈতিক তত্পরতা চালানোর দাবি জানিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংবাদদাতা জানান, কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি শুরু করে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে বিএনপির দুই নেতাকে আটক করলে মানববন্ধন কর্মসূচি পণ্ড হয়ে যায়। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সকালে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানববন্ধন করার জন্য প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হন। এ সময় পুলিশ এসে তাদের জেলা বিএনপির গণশিক্ষ বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আলী আজম ও জেলা শ্রমিক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মোস্তফাকে আটক করে নিয়ে যায়। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানা পুলিশের ওসি মো. নবীর হোসেন সাংবাদিকদের জানান, পুলিশের বিশেষ অভিযানের অংশ হিসেবে বিএনপির ওই দুই নেতাকে আটক করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সকাল ১০টায় খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনের স্থান নির্ধারিত থাকলেও পুলিশ তাত্ক্ষণিকভাবে ভাঙাব্রিজ এলাকায় মানববন্ধন করতে নির্দেশ দেয়। পরে তা ভাঙাব্রিজ এলাকার আদালত সড়কে শুরু হলে অনুষ্ঠানের ব্যানার ও আগত নেতাকর্মীদের ব্যারিকেডের মধ্যে রাখাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে তা পুলিশ-বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে রূপ নেয়। এ সময় দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিএনপি নেতাকর্মীদের পুলিশ লাঠি চার্জ ও ধাওয়া করলে জবাবে বিএনপি নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি প্রবীণ চন্দ্র চাকমা, সাংগঠনিক সম্পাদক ও পৌর বিএনপির সভাপতি আ. রব রাজা, ভারপ্রাপ্ত দফতর সম্পাদক আবু তালেব, পৌর ছাত্রদলের আমির খান, জেলা ছাত্রদলের সোহেল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সেলিম খানসহ ১০ বিএনপি নেতাকর্মী ও পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে এ ঘটনাকে অমানবিক উল্লেখ করে জানান, মানবিক একটি মানববন্ধনে পুলিশের হামলা শুধু ন্যক্কারজনকই নয়, এটি নিন্দনীয়। পুলিশি হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এ ধরনের ঘটনা থেকে পুলিশকে বিরত থাকতে অনুরোধ জানায় খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি। খাগড়াছড়ি সদর মডেল থানার ওসি তারেক মো. আবদুল হান্নান বলেন, সাধারণ মানুষের চলাচল রাস্তা সচল রাখতে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার চেষ্টা করলে বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর ক্ষিপ্ত হন। এক পর্যায়ে তারা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। আমাদের রাঙামাটি প্রতিনিধি জানিয়েছেন, রাঙামাটি জেলা বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে বলেছেন, তাদের মানববন্ধন কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিয়েছে। জেলা বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করতে চাইলে পুলিশ নেতাকর্মীদের ঘিরে রাখে এবং কাউকে বের হতে দেয়নি। অন্যদিকে পুলিশের দাবি, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এলাকার শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করার কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা ছিল। তাই রাস্তায় আন্দোলনের নামে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সৃষ্টি করার সুযোগ না দিতেই পুলিশ সেখানে অবস্থান নেয়। আমাদের ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ অভিযোগ করে বলেছেন, পুলিশি বাধায় তারা মানববন্ধন করতে পারেননি। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নগরীর নতুন বাজার বিএনপির কার্যালয়ের সামনে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে জেলার প্রতিটি নেতাকর্মীর বাড়ির সামনে পুলিশ পাহারা দিয়েছে। তার বাসার সামনেও ব্যারিকেড দিয়েছে র্যাব ও পুলিশ। মির্জা ফখরুলের দাবি : রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সকাল ১০টায় মানববন্ধন কর্মসূচি শুরু হয়। মানববন্ধনে মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপির সুস্পষ্ট দাবি, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি তাদের খাদ্য, নিরাপত্তা ও চিকিত্সার ব্যবস্থা করা হোক। পাশাপাশি জোর কূটনৈতিক তত্পরতার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করা হোক। তিনি বলেন, ওরা হিন্দু না মুসলিম-এটা জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন নেই। সবচেয়ে বড় কথা ওরা মানুষ। সেই মানবতার বিরুদ্ধে আজকে মিয়ানমার সরকার যুদ্ধ শুরু করেছে, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে রুখে দাঁড়াতে হবে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, আজকে জনমত সংগঠিত করে বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ করে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, যাতে মিয়ানমার সরকার গণহত্যা বন্ধ করে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায়। মিয়ানমারের বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারগুলো বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের সীমানা লঙ্ঘন করার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, মিয়ানমারের বিমান যখন বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে তখন এই সরকার চুপ করে থাকে। এটা হচ্ছে সরকারের নতজানু পররাষ্ট্র নীতির পরিচায়ক। মির্জা ফখরুল বলেন, বিশ্ব মানবতার পক্ষে আজকে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে যে ভয়াবহ মানবিক নির্মম অত্যাচার চলছে, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদ জানাতে এখানে দাঁড়িয়েছি। দুর্ভাগ্য সারাবিশ্ব যখন আজকে সোচ্চার হয়ে উঠেছে, সমস্ত মানবতা যখন রুখে দাঁড়িয়েছে তখন বাংলাদেশের সরকার যারা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়নি, যাদের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক নেই তারা আজকে প্রায় নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে। ১৯৭৯ সালে রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রসঙ্গ টেনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে একই ঘটনা ঘটেছিল। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন হলে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। তখন তাদের আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিত্সা প্রদান করা হয়েছিল। একই সঙ্গে কূটনৈতিক তত্পরতার মধ্য দিয়ে মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করা হয়েছিল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নিতে। পরে খালেদা জিয়াও ১৯৯২ সালে যখন রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের অত্যাচারে আবার পালিয়ে চলে আসে তখনও তাদের আশ্রয় দিয়েছিল এবং মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করেছিলেন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে। সংবিধানের কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, আজকে বিশ্ব মানবতার জন্য মানবিক কারণে যেকোনো দুস্থ মানুষকে আশ্রয় দেওয়া ও তাদের পাশে দাঁড়ানো এটা বাংলাদেশের মৌলিক দায়িত্ব। সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, বিশ্ব মানবতার পাশে সবসময় দাঁড়াতে হবে, দুস্থ নির্যাতত মানুষের পাশে সবসময় দাঁড়াতে হবে। সেখানে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। কারণ একটাই এই সরকার গণবিচ্ছিন্ন সরকার, তাদের জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা নেই। প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে আরও বক্তব্য রাখেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, দলের ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর, শামসুজ্জামান দুদু, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুক, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, ঢাকা মহানগর উত্তরের সহ-সভাপতি মুন্সী বজলুল বাসিত আনজু, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসান প্রমুখ। গতকাল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে মির্জা ফখরুল বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানের দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধন ছিল শান্তিপূর্ণ। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খাগড়াছড়ি, যশোর, কুষ্টিয়া, বান্দরবান, রাঙামাটি, ঝিনাইদহ, ফেনী, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, রাজশাহী ও সুনামগঞ্জে জেলা বিএনপি আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিয়েছে। নেতাকর্মীদের আটকের ঘটনাও ঘটেছে। ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকার জোর গলায় কথা বলতে পারছে না’ : বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দশম কারামুক্তি দিবস উপলক্ষে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় বলেই সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে জোর গলায় কথা বলতে পারছে না। রাখাইনে সেনা অভিযানের সমালোচনা করে তিনি বলেন, আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকার সারাবিশ্বকে বলছে, তারা না-কি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযানের কথা বলে তারা মিয়ানমারে মারাত্মকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। আসলে রোহিঙ্গা জাতি-গোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই অভিযান চালাচ্ছে।