শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩ই আশ্বিন ১৪৩১
Smoking
 
স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে কাদের খান
প্রকাশ: ০৯:১৪ am ২৬-০২-২০১৭ হালনাগাদ: ০৯:২৫ am ২৬-০২-২০১৭
 
 
 


গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ মনজুরুল ইসলামকে (লিটন) হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন একই আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ আবদুল কাদের খান। পুলিশের রিমান্ডে থাকার তিন দিনের মাথায় গতকাল শনিবার তিনি এই জবানবন্দি দিলেন।

জবানবন্দি গ্রহণের জন্য আবদুল কাদের খানকে বেলা দুইটায় গাইবান্ধার বিচারিক হাকিম জয়নাল আবেদীনের আদালতে নিয়ে যায় পুলিশ। জবানবন্দি গ্রহণ শেষে রাত ৯টা ২৭ মিনিটে তাঁকে আদালত থেকে বের করা হয়। পুরো সময়ই পুলিশের সদর দপ্তর ও রংপুর রেঞ্জের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আদালত এলাকায় উপস্থিত ছিলেন।

জবানবন্দি দেওয়া শেষ হলে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক আহমেদ বশির সাংবাদিকদের বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে কাদের খান সম্পূর্ণ ঘটনা স্বীকার করেছেন। এরপর তাঁকে আদালতে আনা হয়। তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি যে এই ঘটনার পরিকল্পনা ও অর্থায়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, সে বিষয় অকপটে স্বীকার করেছেন।

কাদের খান কেন এই হত্যায় জড়িত হলেন—এ প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক বলেন, প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কাদের 
খান এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। প্রতিহিংসাটা হচ্ছে ক্ষমতার লোভ, সাংসদ হতে না পারা। হত্যার মাধ্যমেই তিনি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেন। তিনি বলেন, ‘কিলিং মিশনে তিনজনই ছিলেন। এ ছাড়া সহায়তাকারী হিসেবে আরও কয়েকজনের নাম আসতে পারে। কেউ তথ্যদাতা, কেউ আশ্রয় দিয়েছেন। তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছু বলা যাবে না। আরও কেউ সম্পৃক্ত থাকলে তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক বলেন, সাংসদ মনজুরুল হত্যার পরিকল্পনা হয় ঘটনার ছয় মাস আগে। গত অক্টোবরে ওই তিনজনকে দিয়ে একবার হত্যার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তিনজনই গরিব মানুষ। তাঁরা কাদেরের বিশ্বস্ত কর্মী-সমর্থকের মতো কাজ করতেন। তাঁদের অর্থ দিয়ে ও প্রলোভন দেখিয়ে হত্যাকাণ্ডে যুক্ত করেছিলেন কাদের। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জবানবন্দি গ্রহণ শেষে কর্নেল (অব.) কাদের খানকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর আগে মনজুরুল হত্যার ঘটনায় মেহেদী হাসান, শাহিন মিয়া, আনারুল ইসলাম (রানা) ও কাদের খানের গাড়িচালক আব্দুল হান্নান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পুলিশ বলছে, মেহেদী, শাহিন ও আনারুল হত্যায় সরাসরি অংশ নেন।

জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা কাদের খানকে বগুড়া শহরের বাসায় ছয় দিন ‘নজরবন্দী’ করে রাখার পর গত মঙ্গলবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন গাইবান্ধার আদালতে হাজির করে তাঁকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। ওই দিন রাতেই কাদের খানকে সঙ্গে নিয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ছাপরহাটি খানপাড়ায় তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে ছয়টি গুলিসহ একটি পিস্তল উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিন কাদের খান ঘটনাস্থলে উপস্থিত তাঁর ছোট ভাই ইউসুফ খানের স্ত্রী ফিরোজা বেগমের কাছে ক্ষমা চান।

গতকাল দুপুরে কাদের খানের বাড়ির আঙিনায় বসে কথা হয় ফিরোজা বেগমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই দিন তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। পুলিশের কয়েকজন সদস্য তাঁকে ডেকে তুলে ঘরের পাশের গরুর খামারের দিকে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে তিনি হেলমেট ও হাতকড়া পরা অবস্থায় ভাশুর কাদের খানকে দেখতে পান। তখন কাদের খান ফিরোজাকে বলেন, ‘তোমরা আমাকে মাফ করে দাও। আমাকে বিদায় দাও। মনে হয় এ বাড়িতে আর আসা হবে না।’

ফিরোজা বেগম বলেন, ‘একপর্যায়ে ভাইজান (কাদের খান) পুলিশ সদস্যদের বলেন, আমার পরিবারের কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। ওরা কিছু বোঝে না। কেউ কিছু জানে না।’

আবদুল কাদের খান পেশায় চিকিৎসক। তাঁর বাবা নয়ন খাঁ ছিলেন পেশায় কৃষক। পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে কাদের তৃতীয়। সাংসদ মনজুরুল ইসলাম হত্যার পর ওই আসনে উপনির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন তিনি।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (অব.) এ কে এম শহীদুল হক বুধবার চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের বলেন, সাংসদ মনজুরুল হত্যার পরিকল্পনাকারী কাদের খান। তাঁর ইচ্ছা ছিল মনজুরুলকে সরিয়ে পথ পরিষ্কার করে পরবর্তী সময়ে সাংসদ হবেন।

খাগড়াছড়িতে বদলি হওয়ায় গাইবান্ধা জেলার পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম গতকাল দুপুরে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। এর আগে বেলা ১১টায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মনজুরুল হত্যার রহস্য উন্মোচন এবং পরিকল্পনাকারী ও হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করায় তাঁরা সন্তুষ্ট। এ ঘটনায় যাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে ঘটনাটি আরও তদন্ত করা হবে।

শুক্রবার রাত থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তাঁদের কেউ নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। একজন কর্মকর্তা বলেন, কাদের খানের গাড়িচালক আব্দুল হান্নান আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। কিন্তু হত্যার সঙ্গে এখন পর্যন্ত তাঁর সরাসরি কোনো সংশ্লিষ্টতা তাঁরা পাননি। মূল হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন মেহেদী, শাহিন আর আনারুল। সাংসদকে গুলি করেন মেহেদী।

আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার তিন থেকে চার মাস আগে থেকে এই তিনজন কাদের খানের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তিনজনই গরিব পরিবারের সন্তান। প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের ব্যবহার করেন।

মেহেদী, শাহিন ও আনারুল—তিনজনের বাড়িই সুন্দরগঞ্জের শ্রীপুর ইউনিয়নের উত্তর সমস কবিরাজটারি গ্রামে। এর মধ্যে মেহেদী ও শাহিনের বাড়ি পাশাপাশি। তাঁরা দুজন দূরসম্পর্কের আত্মীয়। আর আনারুলের বাড়ি দুজনের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটারের কম দূরত্বে।

বৃহস্পতিবার তিনজনের বাড়িতে যান এই প্রতিবেদক। মেহেদীর ঘর তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। পাশের ঘরে থাকা তাঁর চাচি সখিনা বেগম দাবি করেন, বাড়ি এখানে হলেও মেহেদী, তাঁর মা ও বাবা ৮-১০ বছর আগ থেকেই মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে থাকেন। সেখানে তাঁরা কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন। মাঝেমধ্যে বাড়িতে এসে কিছুদিন থাকেন। মেহেদী বিবাহিত। তাঁর এক কন্যাসন্তান রয়েছে। মেহেদী বাড়িতে থাকতেন না।

শাহিনের মা শহীনুর বেগম বলেন, গত কোরবানির ঈদে শাহিন সর্বশেষ বাড়ি এসেছিলেন। যাওয়ার সময় বলেছিলেন, তিনি নারায়ণগঞ্জের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করতে যাচ্ছেন। এর আগে শাহিন আশুলিয়ায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন।

আনারুলের বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায় তাঁর বোন মনোয়ারা বেগমকে। তিনি বলেন, আনারুল কখনো রিকশা চালাতেন, কখনো পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। আনুমানিক চার মাস আগে তিনি সর্বশেষ বাড়িতে এসেছিলেন।

এদিকে কাদেরের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক শামীম মণ্ডলের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি করেছে তাঁর পরিবার। শামীম পুলিশের কাছে আটক রয়েছেন, এমন তথ্য গণমাধ্যমে এলেও পুলিশের পক্ষ থেকে এখনো কিছু বলা হয়নি।

গতকাল সুন্দরগঞ্জের উত্তর রাজীবপুরে শামীমের বাড়িতে গেলে তাঁর বাবা মহর আলী মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, শামীম ১৫ ফেব্রুয়ারি কাদের খানের পুকুরের মাছ বিক্রি করতে দাড়িয়াপুরে যান। সেখান থেকে সন্ধ্যায় মোটরসাইকেলে ফেরার পথে মণ্ডলহাট এলাকা থেকে পুলিশ তাঁকে আটক করে বলে ওই এলাকার লোকজনের কাছে শুনেছেন। কিন্তু সুন্দরগঞ্জ ও গাইবান্ধায় গিয়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা আটকের কথা স্বীকার করেনি।

সাংসদ হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার মধ্যে শামীম নেই।

 
 

আরও খবর

Daraz
 
 
 
 
 
 
 
 
©ambalanews24.com | Developed & Maintenance by AmbalaIT