আজ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৭ তম জন্ম দিবস আর জাতীয় শিশু দিবস।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের শেখ পরিবারে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মার্চ যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল, তার ডাকনাম খোকা আর পুরোনাম শেখ মুজিবুর রহমান। এই খোকা বা শেখ মুজিবুর রহমানই আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ নামক এই স্বাধীন রাষ্ট্রের স্রষ্টা— জাতির পিতা। তিনি পাকিস্তানি শাসন-শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেন বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য। তিনি পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষুকে ভয় করেননি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ— প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর জন্য আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, স্বাধীন জাতি হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিত হয়েছি।
একটি স্বাধীন দেশের স্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন তাই একটি ঐতিহাসিক দিন। আনন্দময় দিন। বঙ্গবন্ধু শিশুদের অত্যন্ত আদর করতেন, ভালোবাসতেন। শিশুদের নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিলো। তিনি বিশ্বস করতেন, আজকের শিশুই আগামী দিনের জাতির ভবিষ্যত। আগামীতে দেশগড়ার নেতৃত্ব দিতে হবে তাদেরকেই। তারা জ্ঞানে-গরিমায় সমৃদ্ধ হোক। সৃজনশীল মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক—সবসময়ই তিনি তা আশা করতেন। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই তাঁর মধ্যে এমন ভাবনা কাজ করত। আর স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি যখন সবার মাথার মণি, তখনো দেখা যায়— শিশুদের কথা তিনি একটুও ভোলেননি। শিশুদের কোনো সমাবেশে গেলে বা শিশুরা গণভবনে তাঁর কাছে এলে তিনি শিশুর মতো তাদের সাথে মিশে যেতেন; তাদের আনন্দ-খুশিতে শরিক হতেন। অনেক লেখকের লেখায় এসব বর্ণনা আছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে একদিন কচিকাঁচার মেলার কিছু ক্ষুদে বন্ধু তাদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবি নিয়ে যায় গণভবনে—প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অফিসে। ছবিগুলোর অ্যালবাম তাঁর হাতে তুলে দিতে। ছবিগুলো বঙ্গবন্ধু তাঁর রাশিয়া সফরের সময় সে দেশের শিশুদের জন্য নিয়ে যাবেন শুভেচ্ছা-উপহার হিসেবে। সে সময় শিশুদের সাথে বড়রাও ছিলেন কয়েকজন। বঙ্গবন্ধু খুব খুশি হলেন ক্ষুদে শিল্পীবন্ধুদের কাছে পেয়ে। তিনি তাদের হাসিমুখে আদর করলেন। বঙ্গবন্ধু আগ্রহভরে বাচ্চাদের আঁকা ছবিগুলো দেখছিলেন আর ছবি ও ছবির আঁকিয়েদের প্রশংসা করছিলেন মন খুলে। তিনি মুগ্ধ হয়ে বললেন, 'আমার দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে, এসব না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না।' সেদিন বঙ্গবন্ধুর ঘর থেকে বাচ্চারা বের হয়ে আসার সময় তিনি গভীর তৃপ্তিভরা কণ্ঠে বলেছিলেন, 'আজকের কর্মব্যস্ত সারাটা দিনের মধ্যে এই একটুখানি সময়ের জন্য আমি শান্তি পেলাম। শিশুদের সান্নিধ্য আমাকে সব অবসাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে।'
১৯৭২ সালের শেষের দিকের এক সকালে বঙ্গবন্ধু হাঁটতে বেরিয়েছেন, যেমনটি রোজ বেরোন। সঙ্গে বড়ছেলে শেখ কামাল। হটাৎ বঙ্গবন্ধু দেখলেন, একটি বাচ্চা ছেলে; বইয়ের ব্যাগ কাঁধে ঝুলানো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বঙ্গবন্ধু তাকে কাছে ডেকে জানলেন যে, তার পায়ে ব্যথা করছে বলে সে ওভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তিনি নিজে ছেলেটির পায়ের জুতো খুলে দেখেন যে, জুতোর ভেতর একটি লোহার সূঁচালো মাথা বের হয়ে আছে যার খোঁচায় পা দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তখনই ছেলেটির চিকিত্সার জন্য তাঁর দেহরক্ষী পুলিশকে নির্দেশ দিলেন, তার হাতে কিছু টাকাও দিলেন। পরম মমতায় ছেলেটিকে কোলে নিয়ে তিনি আদর করলেন।
বঙ্গবন্ধু কচিকাঁচার মেলা, খেলাঘরসহ অন্যান্য সংগঠনের শিশুবন্ধুদের অনুষ্ঠান ও সমাবেশে গিয়েছেন। তাদের মার্চপাস্ট, লাঠিখেলা ইত্যাদি পরিবেশনা উপভোগ করেছেন। তিনি এত সহজে, এত আন্তরিকভাবে শিশুদের সাথে মিশে যেতেন যে, শিশুরা তাঁকে একান্ত আপন করে নিতো। জানা যায়, শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-বৃদ্ধ সবার কাছেই তিনি ছিলেন মুজিব ভাই; এই সম্বোধনই তিনি পছন্দ করতেন। এরফলে বয়সের ব্যবধান ঘুচে যেতো। তিনি হয়ে উঠতেন সবার একান্ত আপন, আত্মার আত্মীয়। এই অসাধারণ গুণের জন্যই তো তিনি পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন; এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতনার অমূল্য রতন।
শিশুদের প্রিয় মানুষ বঙ্গবন্ধু শিশুদের কল্যাণে ১৯৭৪ সালের ২২ই জুন জাতীয় শিশু আইন (চিলড্রেন অ্যাক্ট) জারি করেন। এই আইনের মাধ্যমে শিশুদের নাম ও জাতীয়তার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে; সব ধরনের অবহেলা, শোষণ, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, খারাপ কাজে লাগানো ইত্যাদি থেকে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত না হলে শিশুদের জন্য নিশ্চয়ই তিনি অনেক বড় কিছু করতেন। কারণ তাঁর স্বপ্নই ছিলো একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়া; আর শিশুদেরকে তিনি মনে করতেন সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার যোগ্য কারিগর।
সেই মহান মানুষ, মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটি আমাদের জাতীয় শিশুদিবস।
বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে শিশুদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশুদিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৯৭ সালের ১৭ই মার্চ দিবসটি পালন শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশাল হূদয়ের এক মহান মানুষ। সাম্প্রদায়িক ভেদ-বিভেদকে তিনি সব সময় ঘৃণা করতেন। অন্যায়-অবিচার, জেল-জুলুম-নির্যাতনের কাছে তিনি কোনোদিন মাথা নত করেননি। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন: আমি বাঙালি। বাংলা আমার দেশ। বাংলা আমার ভাষা। এই বাংলাদেশকে তিনি বড্ড ভালোবাসতেন।