প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিন্হা ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনাদের কাছে আমার আবেদন, আমাকে মিসকোট (ভুলভাবে উদ্ধৃত বা ব্যাখ্যা) করবেন না।’ প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, আমাকে মিডিয়ায় মিসকোট করা হলে আমার পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করা সম্ভব হয় না। আমি কোর্টে মামলা চলাকালে আইনজীবীদের উদ্দেশে অনেক কথাই বলতে পারি। এটা আমাদের অন্তর্নিহিত স্বাধীনতা। কিন্তু প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলতে পারি না। এ বিষয়ে আপনারা খেয়াল রাখবেন। আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা গরিব-অসহায় আইনপ্রত্যাশীদের কাছে আইনের ন্যায্য সুবিধা পৌঁছে দেবেন। গতকাল সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির শহীদ শফিউর রহমান মিলনায়তনে ‘জুডিশিয়াল ইন্টারপ্রিটেশন’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিন্হা বলেন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও জেলহত্যা মামলার অনেক কিছুই তদন্তে উঠে আসেনি, তাই আমি এক দিন তথ্য-প্রমাণসহ লিখে সবকিছু প্রকাশ করে যাব। তখন সেনানিবাসে বসে কারা কারা ষড়যন্ত্র করেছিলেন, কারা ওই দুটি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে জড়িত ছিলেন, সব বেরিয়ে আসবে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিন্হা বলেন, জাতীয় শোকের মাস চলছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে আমরা বারবার ব্যথিত হয়েছি। বাচ্চা ছেলে রাসেলকেও (শেখ রাসেল) পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে। এটা পশুর থেকেও অধম কাজ। প্রধান বিচারপতি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্তে ত্রুটির জন্য তদন্ত কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের গাফিলতি রয়েছে। বিচারপতি হওয়ায় তা বিচারের সময় বলতে পারিনি। এ নিয়ে আমি ভবিষ্যতে কিছু লেখার চেষ্টা করছি। জাতীয় চার নেতা সম্পর্কিত জেলহত্যা মামলা ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা নিয়ে লিখব। মামলা দুটিতে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ছিল। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই ষড়যন্ত্রে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যায় যারা ছিলেন, তারা সবাই দায়ী। তারা ওই রাতে সেনানিবাসে বসে ষড়যন্ত্র করেছেন, বক্তব্য দিয়ে অন্য সেনাসদস্যদের উসকানি দিয়েছেন, পরে তারা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উদ্দেশে রওনা (মার্চ) করেছেন। আমি এগুলো লিখে যাব। দেখিয়ে যাব কারা কারা ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন। তাদের অনেকেই সেনাবাহিনীতে ছিলেন। সেখান থেকে অনেকেই সুযোগ নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন-ওসব লিখে যাব। বিচারপতি ও আইনজীবীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, বিশ্বের তিনজন বিখ্যাত আইনজীবী প্রথম জীবনে রাজনীতি করতেন, পরে তারা সুযোগ্য আইনজীবী ও বিচারপতি হয়েছেন। তারা হলেন ভারতের বিচারপতি কৃষ্ণা নায়ার, বাংলাদেশের আইনজীবী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আমেরিকার প্রধান বিচারপতি আর্ল ওয়ার্ড। তারা হয়তো ছাত্রজীবনে এক রকম রাজনীতি ও আদর্শের চর্চা করেছেন। অবশ্য বিচারপতি হওয়ার পর তারা রাজনীতি ও আদর্শসহ সব অতীত ভুলে গেছেন। তারা সঠিক বিচারের চেষ্টা করেছেন। তাই এখন বিচারপতি ও আইনজীবীদের রাজনীতি না করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মগ্ন হতে হবে, আইনের চর্চা করতে হবে। আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট ও নিম্ন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা আপনাদের অতীত ভুলে যান। নিরপেক্ষভাবে বিচারের জন্য অনেক দায়িত্ব আপনাদের। যদি রাজনীতি করতে হয়, তাহলে আপনারা বিচার বিভাগ ছেড়ে চলে যান। আর যদি বিচারক হতে হয়, তাহলে নিরপেক্ষভাবে বিচার করবেন। মানুষের অধিকার যাতে রক্ষা হয়। সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম ড. কামাল হোসেন বলেন, কলকাতা হাইকোর্ট ১৮৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হল, আজ এর ১৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। আমরা একশ’-দেড়শ’ বছর পালন করব, এটা আমাদের প্রেরণা, এটা ঢাকা হাইকোর্টের জন্য গর্ববোধ করার বিষয়। তরুণরা দেখবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাটা কত। এটার স্বাধীনতা আছে। আইনজীবীদের স্বাধীনতা আছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত। এই স্বাধীনতা কে কেড়ে নিতে পারবেন। কার এত বড় সাহস। কিসের ক্ষমতা। আমরা বহু ক্ষমতা দেখেছি, কিন্তু কেউ আমাদের ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারেনি। ড. কামাল বলেন, বিগত শতকের আশির দশকে সুপ্রিমকোর্টের ১৩ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে আটক করে তখনকার শাসক। তবে সেই শাসক ১৩ জনকে বেশি দিন জেলে রাখতে পারেনি। এটা সম্ভব হয়েছে আইনজীবীদের মধ্যে ঐক্য ছিল বলে। জ্যেষ্ঠ কৌঁসুলি কামাল হোসেন বলেন, ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। আমরা ভীত হলে অন্যরা পেয়ে বসবে। ভীত হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংবিধান রক্ষা করা যাবে না। কামাল হোসেন বলেন, কে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত সংবিধান কে অস্বীকার করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধুর সংবিধান কেউ ছিঁড়ে ফেলতে পারবেন না। তিনি বলেন, ক’জন জনগণকে কিনতে পারবেন ক্ষমতাশালীরা। ১৬ কোটি মানুষকে গুম করা যায় না। কতজনকে গুলি করবেন, বোমা মারবেন। সেই গুলি-বোমা তো আপনাদের নেই। তিনি বলেন, রাজতন্ত্র বানানোর ক্ষমতা কারোর নেই। গণতন্ত্রই মূল উদ্দেশ্য। জনগণের ক্ষমতাই প্রধান। বঙ্গবন্ধু যে আদর্শ ও নীতি রেখে গেছেন, সেটা রাখতে হবে। জনগণই দেশের মালিক। আইনজীবী শান্তিপদ ঘোষের লেখা ওই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জ্যেষ্ঠ কৌঁসুলি সুব্রত চৌধুরী। এতে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন, সম্পাদক এএম মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ অসংখ্য আইনজীবী।