আল্লাহ তাআলা জড়, প্রাণী—সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। আর এই সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ট। যাদের প্রাণ আছে, তাদের খাদ্যের প্রয়োজন হয়। যাদের প্রাণ নেই, তাদের খাদ্যের প্রয়োজন হয় না। পৃথিবীতে প্রাণীর সংখ্যা কত, তা নিয়ে ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে ১৮ হাজার, কারো মতে ৪০ হাজার, কেউ বলেন ৮০ হাজার। স্থলভাগে ৪০ হাজার, আর পানিতে ৪০ হাজার। এই ৮০ হাজার প্রাণিজগতের পানাহারের দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা নিজে গ্রহণ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘পৃথিবীতে বিচরণশীল সব প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহ তাআলার। ’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৬) আল্লাহ তাআলা সব প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব নেওয়ার অর্থ এটা নয় যে তিনি মান্না ও সালওয়ার মতো প্রস্তুত করা খাদ্য সরবরাহ করবেন; বরং প্রাণীকে তার রিজিকের জন্য চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা তার প্রচেষ্টায় ও শ্রমে বরকত দান করবেন এবং তার মাধ্যমেই জীবিকার সুব্যবস্থা করবেন।
জীবিকা উপার্জনের নির্দেশ : ইসলাম জীবিকা উপার্জনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। নবী-রাসুলরা জীবিকা উপার্জনের জন্য শ্রম ব্যয় করেছেন। বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা জীবিকা উপার্জনের জন্য বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করেছেন। বিনাশ্রমের উপার্জনকে তাঁরা ঘৃণা করতেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নামাজ আদায়ের পর তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) অন্বেষণ করো। ’ (সুরা : জুমুআ, আয়াত : ১০) প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, জীবিকা অন্বেষণ করা (অপরাপর) ফরজ আদায়ের পর আরেকটি ফরজ। ’ (মিশকাত, বায়হাকি, পৃষ্ঠা ২৪২)
জীবিকা উপার্জন নবী-রাসুলদের সুন্নাত : নবী-রাসুলদের কোনো না কোনো পেশা ছিল। তাঁরা অলস ছিলেন না। নিজ হাতে অর্জিত সম্পদ ভোগ করতেন। অনেক নবী-রাসুল বকরি চরাতেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলা এমন কোনো নবী পাঠাননি, যিনি বকরি চরাননি। সাহাবিরা (বিস্মিত হয়ে) আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনিও কি (বকরি চরাতেন)? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন—হ্যাঁ, আমিও কয়েক ‘কিরাতে’র বিনিময়ে মক্কাবাসীদের বকরি চরাতাম (সহিহ বুখারি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০১; মিশকাত, পৃষ্ঠা ২৫৭) বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেন, কোনো ব্যক্তি নিজ হাতের উপার্জন থেকে আহার করা অপেক্ষা উত্তম খাদ্য কখনো আহার করেনি (অর্থাৎ নিজ হাতে অর্জিত আহার অপেক্ষা উত্তম কোনো খাদ্য নেই), আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতের অর্জিত সম্পদ খেতেন (সহিহ বুখারি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭৮) মহানবী (সা.) আরো বলেছেন, হজরত মুসা (আ.) বিবাহের মহর ও পানাহারের বিনিময়ে আট কিংবা ১০ বছর নিজেকে মজুরিতে খাটিয়েছেন। (মিশকাত, পৃষ্ঠা ২৫৭; আহমদ, ইবন মাজাহ) অন্য হাদিসে রয়েছে, হজরত দাউদ (আ.) ছিলেন বর্ম প্রস্তুতকারী, হজরত আদম (আ.) ছিলেন কৃষিবিদ, হজরত নুহ (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রি, হজরত ইদ্রিস (আ.) ছিলেন দর্জি এবং হজরত মুসা (আ.) ছিলেন রাখাল। (ফাতহুল বারি : চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০৪)
হাতে অর্জিত জীবিকা সর্বোত্তম জীবিকা : হজরত রাফে ইবন খাদিজ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছে, উত্তম উপার্জন কোনটি? রাসুল (সা.) প্রত্যুত্তরে বলেন, ব্যক্তির নিজ হাতের কাজ এবং হালাল ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, তোমাদের নিজ (হাতে) উপার্জিত সম্পদ থেকে ভক্ষণ করা খাদ্য হলো উত্তম খাদ্য। অবশ্য তোমাদের সন্তান-সন্ততিও নিজ উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত—অর্থাৎ সন্তানের উপার্জিত সম্পদও পিতা-মাতার জন্য তাদের নিজে উপার্জনের মতো।
শ্রমের গুরুত্ব : মহানবী (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে কাজ করার নির্দেশ দিতেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কারো নিজ হাতে রশি নিয়ে তা দিয়ে লাকড়ির বোমা বেঁধে নিজ পিঠে করে বিক্রি করা এবং এর দ্বারা নিজের প্রয়োজন পূরণ করা মানুষের কাছে ভিক্ষা করা কিংবা লাঞ্ছনা পাওয়ার চেয়ে উত্তম।
নবীর শিক্ষা কোরো না ভিক্ষা, মেহনত করো সবে। তিনি আরো বলেছেন, যদি কোনো মুসলমান গাছ লাগায় কিংবা জমি চাষ করে, অতঃপর কোনো পাখি বা মানুষ কিংবা কোনো চতুষ্পদ জন্তু তা থেকে ভক্ষণ করে, তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে বিবেচ্য হবে। (সহিহ বুখারি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১২)
সৎ ব্যবসা ইবাদত : বিভিন্ন উপায়ে অর্থ উপার্জন করা যায়। তন্মধ্যে ব্যবসা হলো উত্তম পন্থা। মহানবী (সা.) বলেছেন, সত্যাশ্রয়ী, আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে অবস্থান করবে। (ইবনে মাজাহ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৫) অন্য জায়গায় মহানবী (সা.) বলেছেন, ব্যবসায়ীদের পাপী হিসেবে হাশরে উঠানো হবে। মুত্তাকি, পুণ্যবান ও সৎ ব্যবসায়ী ছাড়া। (তিরমিজি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩০)
দ্রুত শ্রমিকের পারিশ্রমিক দেওয়া : শ্রমিকের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পারিশ্রমিক দেওয়া জরুরি। এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করা বা গড়িমসি করা মহা অপরাধ। মহানবী (সা.) বলেছেন, শ্রমিকের পারিশ্রমিক তার শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই দিয়ে দাও। (মিশকাত, পৃষ্ঠা ২৫৮, ইবন মাজাহ) রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, বিচার দিবসে আমি তিন শ্রেণির মানুষের প্রতিপক্ষ হবো। এক. যে ব্যক্তি আমার নামের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরে তা ভঙ্গ করেছে, দুই. যে ব্যক্তি স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করেছে এবং তিন. যে ব্যক্তি কাউকে শ্রমিক নিযুক্ত করে নিজের কাজ আদায় করেছে; কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করেনি। (সহিহ বুখারি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা নম্বর ৩০২)