গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আসলাম হোসাইন মোহন ওরফে আবু জাররা ওরফে রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয় ঢাকার বুড়িগঙ্গায়। গুলশান হামলার কয়েক দিন আগে জঙ্গিদের ব্যবহূত অস্ত্রগুলো বহন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে এই রাশেদ। এরপর অস্ত্রগুলো নিয়ে রাশেদ কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়িতে ওঠে। গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ও গোয়েন্দা তত্পরতার কারণে একের পর এক জঙ্গি সদস্য গ্রেফতার হওয়ার পর নব্য জেএমবি সদস্যদের পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার ঘাটতি দেখা দেওয়ায় বিশ্বাসঘাতক হিসেবে শনাক্ত করে জঙ্গি নেতারা তাদের অন্তত ৫ থেকে ৭ জন সদস্যকে নিজেরাই হত্যা করে বলে জানান মনিরুল ইসলাম। এর আগে গত শুক্রবার নাটোরের সিংড়া থেকে রাশেদকে গ্রেফতার করেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা। গতকাল হলি আর্টিজান হামলা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিটির পরিদর্শক হুমায়ুন কবির জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাশেদকে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে হাজির করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিন রাশেদের ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মনিরুল ইসলাম বলেন, নব্য জেএমবির নেতা রাশেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য সংগ্রহের পরই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে। তিনি বলেন, রাশেদকে গ্রেফতার করায় গুলশান হামলার তদন্ত এখন শেষ পর্যায়ে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হলি আর্টিজানে হামলা মামলার চার্জশিট প্রস্তুত করা হবে। মনিরুল জানান, রাশেদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে যে অস্ত্রগুলো ঢাকায় নিয়ে আসে তার মধ্যে রয়েছে চারটি নাইন এমএম পিস্তল ও আটটি ম্যাগাজিন। একটি পিস্তল রাশেদ তার কোমরে করে নিয়ে আসে। বাকি অস্ত্র নিয়ে আসে ফলের ঝুড়িতে করে। রাশেদ নিহত জঙ্গি জেএমবির সমন্বয়ক তামিম চৌধুরীর খুব বিশ্বস্ত হওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে অস্ত্র আনার দায়িত্ব তার ওপর ছিল। তারপর কল্যাণপুর থেকে সেই অস্ত্র বাশারুজ্জামান চকলেট বসুন্ধরার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে পুলিশ। পুলিশের কাছেও এসব তথ্য স্বীকার করেছে রাশেদ। মনিরুল ইসলাম আরও জানান, কাজের দক্ষতার বিচার-বিশ্লেষণ করে রাশেদকে বড় পদে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল তামিম। কিন্তু তামিম জঙ্গিবিরোধী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হওয়ায় তার আর বড় পদে যাওয়া হয়নি। তখন মাইনুল ইসলাম মুসা নব্য জেএমবির আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিল। মুসার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তাদের সঙ্গে রাশেদের দূরত্ব বেড়ে যায়। রাশেদের মন অনেক দিন খারাপ থাকার পর সংগঠনের পুরনো সদস্য ও নতুনদের নিয়ে দল গোছানোর চেষ্টা করে বলেও জানান মনিরুল ইসলাম। জঙ্গি রাশেদের বরাত দিয়ে মনিরুল ইসলাম জানান, নিহত জঙ্গি তানভীর কাদেরকেও আজিমপুরের বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল রাশেদ। শুধু তাই নয়, বসুন্ধরার বাসায় ফার্নিচার ক্রয় করে রাশেদ ও আকিকুজ্জামান (মোনায়েম খানের নাতি) পৌঁছানোর কাজেও সম্পৃক্ত ছিল তারা। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম জানান, হলি আর্টিজান হামলায় অংশগ্রহণের জন্য রাশেদকেও রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রধান সমন্বয়ক রাশেদকে অন্য অপারেশনের কাজে নিয়োজিত করবে বলে শেষ মুহূর্তে সরিয়ে নেওয়া হয়। গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের জঙ্গি আস্তানায়ও রাশেদের আসা-যাওয়া ছিল বলে জানান তিনি। গাজীপুরের দুটি বাড়িতে অভিযানের পরপরই রাশেদ আবার উত্তরাঞ্চলে আত্মগোপন করে। হলি আর্টিজান হামলাকারীদের ‘গ্রেনেড প্রশিক্ষক’ রাশেদ : গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী রাশেদ ছিল হামলাকারীদের গ্রেনেড প্রশিক্ষক। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। মনিরুল ইসলাম বলেন, হামলার আগে বুড়িগঙ্গা নদীতে শামীম মোবাশ্বের ও রোহান ইমতিয়াজকে নিয়ে কীভাবে গ্রেনেড ছুড়তে হয় তার প্রশিক্ষণ দেয় র্যাশ। প্রশিক্ষণের সময় গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে রোহান ইমতিয়াজ আহত হয়। এ কথাও স্বীকার করেছে রাশেদ। নব্য জেএমবিতে অন্তর্কলহ : কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম ব্রিফিং শেষে সাংবাদিকদের বলেন, আস্থাহীনতার কারণেই সংগঠিত হতে পারছে না নব্য জেএমবি সদস্যরা। নব্য জেএমবিতে প্রচণ্ড অবিশ্বাস থেকেই তাদের মধ্যে অন্তর্কলহ শুরু হয়। এই কলহের কারণে হলি আর্টিজান হামলার মামলার অন্যতম পলাতক আসামি হাদিসুর রহমান ওরফে সাগরকে খুঁজে পেলে তাকেও হত্যা করতে পারে জেএমবি। এর আগে পুরনো জেএমবি সদস্যরা তাদের ৫ থেকে ৭ জনকে মেরে ফেলেছে। এদের মধ্যে নজরুল ছাড়া আর বড় মাপের তেমন কেউ ছিল না। বাকিরা সবাই ছোট মাপের কর্মী। বর্তমানে দেশে থাকা জঙ্গি সদস্যদের বড় কোনো হামলার সক্ষমতা বা অপারেশনাল ক্যাপাসিটিও নেই বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। তবে প্রবাসী বাঙালিদের কর্মকাণ্ড নিয়ে সংশয়ের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, প্রবাসীদের কেউ কেউ জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ছে। হলি আর্টিজান হামলার সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো দেশ, দল বা সংস্থার সম্পৃক্ততা আছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। তদন্ত চলছে। আইএসের যেমন নির্দিষ্ট কোনো আইডোলজি নেই, পুরনো বা নব্য জেএমবির তেমন কোনো নির্দিষ্ট আইডোলজি নেই। এরা ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে বিভিন্ন মানুষকে বিশেষ করে যারা ধর্ম সম্পর্কে কম জানে তাদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা সৃষ্টি করত। মূল ঘরানার জেএমবি আর নেই। নব্য জেএমবি বা অন্যরা এখন দল গোছানোর কাজে মনোযোগী। তাদের অপারেশন বা হামলার প্রস্তুতি নেই। এখন তারা মূলত সদস্য রিক্রুট করার কাজে বেশি মনোযোগী। হাদিসুর রহমান ওরফে সাগরও একটা গ্রুপ তৈরির চেষ্টা করছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে।