সরকারি নির্দেশ লংঘনের দায়ে তিন ধরনের শাস্তির মুখে পড়তে যাচ্ছে ৩৯ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে দু’টির শিক্ষার্থী ভর্তি ও ৩৪টির নতুন কোর্স কারিকুলাম অনুমোদন বন্ধ এবং তিনটির শিক্ষার্থী ভর্তিতে ‘সতর্কতা’ জারির চিন্তাভাবনা চলছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকার এক বছর আগে ‘স্থায়ী’ ক্যাম্পাসে যাওয়ার আলটিমেটাম দিয়েছিল। কিন্তু তারা এতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘এক বছর আগে আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে বলেছি। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেই সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী শাস্তির আগাম বার্তা দিয়ে তখন চিঠি দেয়া হয়। সুতরাং, নিজেদের দেয়া সময়সীমা যারা মানেননি, তারা চিঠিতে উল্লিখিত শাস্তির মুখোমুখি হবেন।’
১৯৯২ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে ৫৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায়। অবৈধ কর্মকাণ্ডের দায়ে সরকার ২০০৬ সালে পাঁচটির কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। যদিও পরবর্তী সময়ে মামলা এবং সরকারি মহলের ‘নমনীয়তায়’ তিনটি ফিরে এসেছে। অপর দু’টির ওপর এখনও স্থগিতাদেশ আছে। গত ১৬ জুলাই সরকার দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা করে। এ অবস্থায় তিন ক্যাটাগরির ৩৯টিকে গত বছরের জানুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আলটিমেটাম দেয়া হয়। পাশাপাশি এক বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে না গেলে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধসহ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। অপর ক্যাটাগরিতে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়া ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ধন্যবাদ’পত্র দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, তিন ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে, যেগুলো জমি কেনেনি। গত বছরের ২৪ জানুয়ারি এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে আলটিমেটাম দেয়া হয়েছিল। আজ এগুলোকে দেয়া এক বছরের সময়সীমা শেষ হচ্ছে। তখন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করে বলা হয়েছিল, স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে না পারলে তাদের শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেয়া হবে। জমি কিনেছে এবং তাতে ভবন নির্মাণাধীন এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে রাখা হয়। এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়কে গত বছরের ১৯ জানুয়ারি সতর্কপত্র পাঠানো হয়। তাদের দেয়া সময় ইতিমধ্যে পার হয়েছে। এগুলোকে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার হুশিয়ারি দেয়া হয়েছিল। তৃতীয় ক্যাটাগরিতে ছিল, জমি কিনেছে কিন্তু ভবনের কাজ শুরু করেনি। ভবনের নকশা অনুমোদনসহ অন্য কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। গত বছরের ১৪ জানুয়ারি এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়কে নোটিশ দেয়া হয়। এক বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে না পারলে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধের পাশাপাশি আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার হুশিয়ারি ছিল এতে।
এর আগে এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও চার দফায় আলটিমেটাম দিয়েছিল সরকার। ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হওয়ার পরই প্রথমবার ‘রেড এলার্ট জারি’ করা হয়। সে অনুযায়ী ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় তখন স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার উদ্যোগই নেয়নি। পরে দ্বিতীয় দফায় ২০১২ সালে, তৃতীয় দফায় ২০১৩ সালে, চতুর্থ দফায় ২০১৫ সালের জুনে আলটিমেটাম দেয়া হয়। পঞ্চম দফায় দেয়া আলটিমেটাম শেষ হচ্ছে এখন।
বারবার এভাবে আলটিমেটাম বর্ধিত করা প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী যুগান্তরকে বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি আছে। তাই চাইলেও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে পারছি না। কিন্তু এবার আর কেউ রেহাই পাবেন না। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে ৯৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে ৮০ কার্যক্রম চালু হচ্ছে। বাকিরা অনুমোদন পেলেও কার্যক্রম শুরু করেনি।
ভর্তি বন্ধের তালিকায় ২টি : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার ওপর কয়েক দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। তাতে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি এবং ইবাইস ইউনিভার্সিটি জমি কেনেনি। এর মধ্যে ইবাইসের আবার মালিকানা দ্বন্দ্ব আছে। আলটিমেটামপত্র অনুযায়ী এই দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা।
কোর্স কারিকুলাম বন্ধের তালিকায় যেগুলো : জমি কিনেছে এবং ভবনাদি নির্মাণ করছে এমন ক্যাটাগরিতে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ক্যাটাগরিতে তিন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে ১০টির নির্মাণকাজ চলছে। পাশাপাশি এগুলো শিক্ষা কার্যক্রমও স্থায়ী ক্যাম্পাসে কিছুটা স্থানান্তর করেছে। এগুলো হচ্ছে- আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এআইইউবি), নর্দান ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অব সায়েন্সেস, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। এগুলোর মধ্যে শেষটির বিরুদ্ধে শিক্ষা নিয়ে নানা বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। আরও অন্তত দু’টির বিরুদ্ধে সনদ বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। এমন অভিযোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর ইউজিসিতে চিঠি দিয়েছে। এআইইউবিসহ কয়েকটির একাধিক ক্যাম্পাস পরিচালনার অভিযোগ আছে, যার অনুমোদন নেই।
প্রতিবেদন মতে, আরও ১০টি আইনে নির্ধারিত পরিমাণ কিনে ক্যাম্পাস নির্মাণ করছে। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম মোটেও চালু করেনি। এগুলো হচ্ছে, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, আশা ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি। এর মধ্যে প্রাইম এবং সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি আইনে নির্ধারিত পরিমাণের কম জমিতে ক্যাম্পাস করছে। আলটিমেটামে এই ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার হুশিয়ারি ছিল। বাংলাদেশ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়কে আইন লংঘনের দায়ে শোকজ করা হয়েছে। ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘আইনানুগ ব্যবস্থার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া, অর্থ এবং কারাদণ্ড আছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। তবে এর আগে শিক্ষার্থীর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স কারিকুলাম বন্ধের শাস্তি দিয়েছে ইউজিসি । আমরা সেই সুপারিশ করব।’
প্রতিবেদন অনুযায়ী জমি কিনেছে কিন্তু কাজ শুরু করেনি, অগ্রগতিও সন্তোষজনক নয়- এমন ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে আছে স্টেট ইউনিভার্সিটি, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, স্টামফোর্ড অন্যতম। এই ক্যাটাগরিতে ব্র্যাক, শান্ত-মারিয়াম এবং সাউথইস্ট ও মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি আছে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক দশা ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ার। ওটি ‘কেন বন্ধ করা হবে না’- সেই শোকজ নোটিশ দেয়া হয়েছে। একইভাবে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিকেও শোকজ করা হয়েছে।
ভর্তিতে সতর্কতা : তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মালিকানা দ্বন্দ্ব প্রকট। এর মধ্যে প্রিমিয়ার ও সিলেট ইন্টারন্যাশনাল স্থায়ী ক্যাম্পাস আছে। কিন্তু মালিকানা দ্বন্দ্বের কারণে তারা ওই তালিকাভুক্ত হয়নি। ইবাইসেও মালিকানা দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এই তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তির ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বলার চিন্তাভাবনা আছে।
নির্দেশনা ও আইন উপেক্ষা ৪টির : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, এক বছর আগে প্রাইম ও সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি ছিল ‘নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কম জমিতে ক্যাম্পাস নির্মাণাধীন’ গ্র“পে। উভয় বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্ধারিত পরিমাণ জমিতে স্থায়ী ক্যাম্পাস বানাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রাইম মিরপুরে আধা একর জমিতে স্থায়ী ক্যাম্পাস বানাচ্ছে। সেন্ট্রাল উইমেন্স মাত্র ৩৩ শতাংশ জমিতে ক্যাম্পাস গড়েছে। এ ছাড়া গত বছর আলটিমেটাম দেয়ার সময়ে সাউথইস্ট এবং মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটির ফাউন্ডেশনের নামে জমি ছিল। এক বছর পরও ফাউন্ডেশনের নামের জমিতেই কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে স্থানান্তর করেনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সে হিসেবে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয় আইন এবং সরকারের নির্দেশনা দু’টিই উপেক্ষা করেছে।
আইন কী বলে : ১৯৯২ সালের আইনের অধীনে উল্লিখিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা ছিল। এগুলোর প্রতিষ্ঠার বয়স ১২ থেকে ২০ বছর হয়েছে। এগুলোর ব্যাপারে ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৪৭(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনে যাই থাকুক না কেন এই আইন কার্যকর হবার পূর্বে সাময়িক অনুমতিপ্রাপ্ত কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইিেতমধ্যে সনদ গ্রহণপূর্বক স্থায়ী না হইয়া থাকিলে এই আইন কার্যকর হবার পর উক্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ধারা ৯ এর শর্তাবলী পূরণ সাপেক্ষে সনদপত্র গ্রহণ করিতে হইবে।’ ৯ নম্বর ধারায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর হলে এক একর এবং অন্যত্র কমপক্ষে দুই একরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। ১০ নম্বর ধারায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে গিয়ে সনদ না নিলে ১২ ধারা অনুযায়ী ভর্তি ও শিক্ষাসংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার বিধান আছে। ৪৭(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সনদপত্র গ্রহণ না করিলে