(১২) আজাদ নাই ৷ সে করাচির উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছে ৷ উড়োজাহাজ তাকে নিয়ে চলে গেছে ওই আকাশের ওপর দিয়ে ৷ এ তো যে-সে কথা নয় ৷ এ তো মাওয়া বা বিক্রমপুর যাওয়া নয় যে বেলাবেলি চলে আসা যাবে ৷ ইচ্ছা করলেই তো হুট করে চলে আসা যাবে না ৷ পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান, মধ্যখানে অন্য দেশ, হাজার মাইলের ব্যবধান ৷ ওখানকার ভাষা আলাদা, খাবার আলাদা, চালচলন আলাদা ৷ পাসপোর্ট লাগে না সত্য, কিন্তু আলাদাই তো দেশ ৷ একা ছেলে তাঁর কোথায় থাকবে, কী খাবে ? অসুখ-বিসুখ হলে তাকে কে দেখবে ?
মা সারা দিন ডাকপিয়নের জন্যে পথ চেয়ে থাকেন ৷ ছেলের কোনো কুশল যদি পাওয়া যায়! নফল রোজা রেখেছেন তিনি ৷ বাসার সবাই, তাঁর ভাগ্নে-ভাগি্নরা, তাঁর বড় বোনের ছেলে ডালু, সবাই তাঁকে দেখলেই গম্ভীর হয়ে যায় ৷ এ হয়েছে আরেক মুশকিল ৷
তিনি প্রথমে কল্পনা করতেন আজাদ কোথায় কী করছে, সারাক্ষণ বিড়বিড় করতেন-’এই তো, এখন আজাদ প্লেনে ৷ এই তো এখন আজাদ করাচি পৌঁছেছে ইনশাল্লাহ ৷’ তারপর তো তিনি আর বলতে পারেন না, আজাদ কোথায় কার কাছে গিয়ে উঠেছে ৷ তখন তিনি গুনতে আরম্ভ করেন ঘন্টা, ১২ ঘন্টা হলো আজাদ গেছে ৷ ১৮ ঘন্টা হলো আজাদ ঢাকা ছেড়েছে ৷ তারপর এল দিন গণনার পালা ৷ আজ দুদিন হলো আজাদ করাচিতে ৷ তাহলে চিঠি আসে না কেন ? ও যদি পৌঁছেই একটা চিঠি লেখে, তাহলে কালকের প্লেনে চিঠিটা কি ঢাকায় আসতে পারে না ? তাহলে পিয়ন কেন আজও চিঠি দিল না ? এক দিন, দু দিন, তিন দিন, চার দিন ৷
সাফিয়া বেগমের বুকের ওপরে যেন পাথর চেপে বসে ৷ আজাদ ঠিকভাবে পৌঁছেছে তো ? বিমান ঠিকভাবে নেমেছে তো ? কোনো দুর্ঘটনা ? আল্লাহ না করুন ৷ কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তো রেডিওতে পত্রপত্রিকায় খবর পাওয়া যেত ৷ তিনি জায়নামাজে বসেন ৷ নামাজ শেষে দোয়া-দরুদ পড়েন ৷ তারপর করেন দীর্ঘ মোনাজাত ৷ ‘হে আল্লাহ, আমার ছেলেটাকে ঠিকভাবে রেখো আল্লাহ ৷’
চার দিন পরে চিঠি আসে ৷ একটা চিঠি ৷
পিয়ন এসে দরজায় কড়া নাড়তেই ছুটে যান সাফিয়া বেগম ৷ এর আগেও অনেকবার পিয়ন এসেছে ভেবে তিনি ছুটে ছুটে গেছেন ৷ কিন্তু এ-ও এসেছে ৷ পিয়ন আসেনি ৷ এবার সত্যি পিয়ন ৷ সাফিয়া বেগমের বুক ধড়পড় করে ৷ তিনি চিঠি হাতে নিয়ে খামটাই উল্টেপাল্টে দেখেন ৷ বাই এয়ার মেইল ৷
তাঁর আজাদের হাতের লেখা ৷
TO
Mrs. Safia Begam
61 B. K Das Road
Farashganj
Dacca-1
East Pakistan
খামটা তিনি ছিঁড়বেন কী করে ? ভেতরে আজাদের লেখা চিঠিটা যদি ছিঁড়ে যায় ৷ খানিকক্ষণ তঁাঁর নিজেকে হতবুদ্ধি লাগে ৷ তারপর তিনি আলোর বিপরীতে ধরেন খামটা ৷ ভেতরের চিঠিটার অবস্থানটা বোঝা যায় ৷ তিনি একপাশ দিয়ে খামটা যত্ন করে ছেঁড়েন ৷ তাঁর সমস্তটা শরীর কাঁপছে ৷
11.8.64
Karachi
মা,
আমার ভালোবাসা গ্রহণ করিও ৷ আশা করি ভালোই আছ ৷ আমি সুস্থভাবেই করাচি পৌঁছেছি ৷ এয়ারপোর্টে ডলদাদা এবং তার দুই বন্ধু ছিল ৷ এখন আমি ‘প্যালেস হোটেলে’ আছি ৷ গতকাল ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম ৷ ইউনিভার্সিটি করাচি শহর থেকে ১৫-২০ মাইল দূরে ৷ হোস্টেল দেখলাম ভালোই কিন্তু খুব কড়া ৷ হোস্টেলের গেট লোহার তৈরি এবং খুব উঁচা ৷ পাশে খুব ছোট ৷ দেওয়ালগুলি খুব উঁচা এবং দেওয়ালের উপরে ভাংগা কাচ বসান ৷ এখন সকাল ৮টা বাজে, ৯টার সময় ডল আসবে এবং পরে ইউনিভার্সিটিতে যাব ভর্তির ব্যাপারে ৷ যা হোক, আমার জন্যে তুমি চিন্তা কোরো না ৷ তুমি নিজ স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিও ৷ এখন আর সময় নেই, পরে আরো চিঠি লিখে সব জানাব ৷ আশীর্বাদ কোরো, যেন আমার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় ৷
ইতি তোমার
আজাদ
এই ঠিকানায় চিঠি দিও
Azad.
C/O Q. B. Islam
19-F Block 6
PECHS
KARACHI-19
মা ঘুরেফিরে কয়েকবার চিঠিটা পড়েন ৷ তারপর বড় বোনের ছেলে ডালুকে ডেকে পড়তে দেন ৷ জায়েদ এসে তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, আজাদ দাদার চিঠি সেও পড়বে ৷
জুরাইন গোরস্তানে আম্মাকে শুইয়ে রেখে এসে জায়েদের দিনগুলো এলোমেলো হয়ে যায় ৷ সে হিসাব করে কূল পায় না, কী কঠিন মহিলা ছিলেন তিনি, আজাদের মা ৷ তাঁর সমস্ত ব্যথা, সমস্ত দুঃখ তিনি একাই পুরোটা জীবন বহন করে গেছেন ৷ সুখের সংসার ছাড়ার দুঃখ, মুক্তিযুদ্ধে নিজের ছেলেকে হারানোর দুঃখ ৷ কিন্তু তিনি কোনো দিনও চাননি, এসব কথা মানুষ জানুক, এসব নিয়ে লেখালেখি হোক ৷ জাহানারা ইমাম এসেছিলেন অনেকবার, ‘আপা, আপনার জীবনের কথা বলেন, এসব লিখে রাখা দরকার ৷’ তিনি রাজি হননি ৷ জায়েদকে বলে গেছেন, ‘খবরদার, আমার ছবি কাউকে দেবে না ৷’ জায়েদ আম্মার ছবি কাউকে দেবে না ৷ এ সত্যি ৷ কিন্তু আরো কিছু জিনিস তো আছে তার কাছে ৷ যেমন আছে করাচি থেকে মাকে লেখা আজাদ দাদার চিঠি ৷
জায়েদ তার বাক্সে হাত দেয় ৷ চিঠিগুলো বের করে ৷ আপন মনে পড়ে ৷ পড়ে কাঁদে ৷ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে ৷ কী করবে এখন এসব নিয়ে সে ৷
করাচি থেকে লেখা আজাদ দাদার প্রথম চিঠিটা এত দিন পর পড়ে নানা কথাই মনে হয়ে জায়েদের ৷ আজাদ কথাটার অর্থই তো স্বাধীন ৷ আর দ্যাখো, তার আজাদ দাদা করাচিতে তার হোস্টেল দেখে প্রথমেই যেটা লক্ষ করল, তা হলো, চারদিকের দেয়াল উঁচু, দেয়ালের ওপরে কাচ বসানো, গেট লোহার, আর পাশে ছোট ৷ আশ্চর্য না ? তার স্বাধীনতা যে এ হোস্টেলে থাকলে চলে যাবে, এটাই ছিল তার প্রথম চিন্তা ৷
এই চিঠি যে-তারিখে লেখা, ঠিক তার দুদিন পরের তারিখের আরেকটা চিঠি বের হয় ৷ এ চিঠিতে আজাদ মাকে জানায়, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ব্যাপার প্রায় পাকা, ইউনিভার্সিটিতে বেশ কিছু বাঙালি ছেলে আছে, আর মায়ের প্রতি অনুরোধ জানায় চিন্তা না করার জন্যে, শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়ার জন্যে, তার জন্যে দোয়া করার জন্যে আর একটা চাকর রাখার জন্যে ৷
এ চিঠিতে আর পরের চিঠিগুলোতে আজাদ বারবার বলেছে, এবার সে ফার্স্ট ক্লাস পেতে চায়, যাতে সে পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে মার মুখে হাসি ফোটাতে পারে ৷
এদিকে মা ছেলের জন্যে পাঠিয়েছেন সন্দেশ ৷ আজাদ সেটা নিজে খেয়েছে, খাইয়েছে আশপাশের অনেক ছাত্রকে ৷ তারা সবাই সন্দেশের প্রশংসা করেছে ৷ চিঠিতে আজাদ সে-কথা লিখতে ভোলেনি ৷
আজাদ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে ৷ তার নিজের নামে বরাদ্দ করা হোস্টেলের সিটে উঠেছে ৷
একদিন গভীর রাতে তার ঘুম ভেঙে যায় ৷ তার রুমমেট আরো দুজন ৷ তারা ঘুমাচ্ছে ৷ এদের একজন সিন্ধি, আরেকজন করাচির ৷ এদের প্রত্যেকের বাবা দ্বিতীয়বার সৎকার্য করেছেন ৷ তিনজন একই রকম ভাগ্যঅলা মানুষ যে কীভাবে একত্র হলো, আল্লাহ জানে ৷
‘আমি এখন এই করাচির হোস্টেলে’, আজাদ ভাবে ৷ ‘আর জানি না, ঢাকায় মা কী করছে’-সে বিড়বিড় করে ৷ তার ইচ্ছা করছে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে আলো জ্বালিয়ে চিঠি লিখতে বসে ৷ কিন্তু তা উচিত হবে না ৷ এত রাতে আলো জ্বালালে রুমমেটদের অসুবিধা হবে ৷ কালকে ভোরে উঠে সে লিখতে বসবে চিঠি ৷ অনেক বড় চিঠি লিখবে মাকে ৷ কী লিখবে সে ?
‘মা, এখানে আমি ভালোই আছি ৷ কোনো গণ্ডগোল নাই ৷ ভালো ইউনিভার্সিটি আর সুশৃঙ্খল পরিবেশ ৷
তবে দূরে থাকি বলে, একা থাকি বলে, খুব ছোটখাটো বিষয়ের জন্যে মনটা মাঝে মধ্যে কেমন করে ওঠে ৷ যেমন ধরো ভাত ৷ এমন তো না যে ঢাকায় থাকতে রোজই ভাত খেতাম ৷ রুটি-তন্দুরি-মোগলাই দিয়ে দু-তিন দিন পার যে কখনও করিনি, তেমন তো নয় ৷ কিন্তু করাচিতে এসে ভাত জিনিসটা হোস্টেলের ডাইনিংয়ে খেতে পাচ্ছি না, ভাত খাওয়ার জন্যে তিন মাইল দূরে ইস্ট পাকিস্তান হোটেলে যেতে হবে, এটা যেন সহ্য হয় না ৷ এখন মনে হয়, তুমি যে ভাত রাঁধতে, তাতে বলক উঠত, সুন্দর মাড়ের গন্ধ বেরুত, সেই গন্ধটাও কত সুন্দর ছিল ৷ শুধু একটু ভাতের গন্ধের জন্যেও মনটা খারাপ করে মা ৷ একই রকম মনটা আকুল হয়ে ওঠে একটু বাংলায় কথা বলার জন্যে, বাংলায় কথা শোনার জন্যে ৷ আমাদের হোস্টেলে যে কজন বাঙালি ছেলে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি, তারা এখন একসাথে হওয়ার জন্যে, একসাথে চলার জন্যে, একটু বাংলায় কথা বলার জন্যে, একটু বাংলা কথা শোনার জন্যে আঁকুপাঁকু করি ৷ রাস্তায় যদি কোনো পূর্ব পাকিস্তানের ট্যাঙ্অিলার সঙ্গে দেখা হয়, যদি তার সঙ্গে উর্দুতে কথা বলে খানিকক্ষণ পথ চলার পরে জানতে পারি সে বাঙালি, কী আনন্দটাই না হয় ৷ তার সাথে বেমালুম তখন বাংলা কথা বলা শুরু করে দিই ৷ মনে হয় সাত জনমের আপন একজনকে পেলাম ৷ এখন মনে হচ্ছে, বাঙালি আমরা আরেক জাতি ৷ ওরা, পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুঅলারা আরেক জাতি ৷ মুসলমান হলেই জাতি এক হয় না ৷
এক যে হয় না, সেটা ওদের আচার-আচরণেও টের পাওয়া যায় ৷ ইতিমধ্যে আমার এক বন্ধু পেয়ে গেছি, রাওয়ালপিন্ডি বাড়ি, হিজাজি খান ৷ সে খুব ভালো ছেলে ৷ আমাকে খুবই পছন্দ করে ৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি বলব, পুরো পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের লোকদের ধারণা হয় খুব খারাপ, নয় তো ধারণাই নাই ৷ ওরা আমাদের মুসলমানও ভালোমতো মনে করে না, মানুষও ঠিক মনে করে কি না, সন্দেহ ৷ পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছি শুনলেই নানা রকমের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ৷
আর আছে নানা রকমের বৈষম্য ৷ পশ্চিম পাকিস্তানে না এলে বোঝা যাবে না, বাঙালিদের ওরা কতভাবে বঞ্চিত করে রেখেছে ৷ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে বাঙালি নাই বললেই চলে, সেনাবাহিনীতেও বাঙালি কম নেওয়া হয় ৷ বার্ষিক বাজেটে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে বরাদ্দ অনেক বেশি ৷ আমাদের ঢাকার সঙ্গে ওদের করাচির তুলনা করলে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আর বৈষম্য চোখে পড়ে ৷
আমার সাথে একটা মেয়ের বন্ধুত্ব হয়েছিল ৷ পাঞ্জাবি মেয়ে ৷ তবে মোহাজের ৷ ইন্ডিয়ান পাঞ্জাব থেকে এসেছে ‘৪৭-এর পরে ৷ একদিন কতগুলো পাঞ্জাবি এসে বলল, খবরদার, বাঙালি হয়ে পাঞ্জাবি মেয়ের সাথে মিশবি না ৷ তারা সব গুণ্ডা ধরনের ছেলে ৷
আমার ইচ্ছা হলো কষে মার লাগাই ৷ ঢাকা হলে আমার সাথে কেউ এ রকম বাজে ব্যবহার করলে আমি কী করতাম তুমি কল্পনা করতে পারো! মেরে সব কটার চামড়া খুলে ফেলতাম ৷ কিন্তু বিদেশ বলে কিছুই করতে পারলাম না ৷ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছি ৷ মাঝে মধ্যে মনে হয়, কিসের পড়াশোনা, দেশে ফিরে যাই ৷
করাচি আর যাই হোক, দেশ নয়, বিদেশ ৷
আমি শুধু তোমার মুখের দিকে চেয়ে এই বিদেশে থাকা আর অপমান সহ্য করার কষ্ট করছি ৷ দোয়া করো, যেন তাড়াতাড়ি পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে তোমার কষ্ট দূর করতে পারি ৷’
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে আসে ৷ আজানের ধ্বনি শোনা যায় ৷ আজাদ ঘুমিয়ে পড়ে ৷
সকালবেলা ক্লাস ৷ ক্লাস থেকে ফিরে এসে সে মাকে চিঠি লিখতে বসে যায় ৷ চিঠি লেখার জন্য নীল রঙের প্যাড কিনে রেখেছে সে ৷ নীল রঙের কালিতে লেখে :
মা,
চিঠি লিখতে দেরি হয়ে গেল বলে কিছু মনে কোরো না ৷ কারণ একদম সময় পাই নাই ৷ এখানে সবাই সব সময় ব্যস্ত থাকে ৷ আমি এখন হোস্টেলে ভালোই আছি ৷ আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে ৷ আমি এখনও রীতিমতো পড়া শুরু করি নাই ৷ আমরা তিনজন এক রুমে থাকি ৷ এখানকার খাবার জিনিস মোটেই ভালো না ৷ এখানে অনেক পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ছেলে আছে এবং আমাদের আলাদা বাংলা সমিতি আর ক্লাব আছে ৷ এখানকার মাস্টাররা খুব ভালো ৷ এখানে নিয়ম করেছে যে ক্লাসে মাস্টাররা উর্দুতে পড়াবে ৷ কিন্তু আমাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হবে আশা করি ৷ উর্দুর জন্য খুব অসুবিধা হচ্ছে ৷ দোয়া কোরো যেন অসুবিধা না হয় ৷ আর তোমার শরীর কেমন আছে ৷ নতুন কোনো খবর থাকলে বোলো ৷ চিঠির উত্তর দিও ৷ এখন আসি ৷ আমার জন্য চিন্তা কোরো না ৷
ঠিকানা
Magferuddin Ahmed Chowdhury
BLOCK 2 Room No 28
KARACHI UNIVERSITY HOSTEL
KARACHI 32
রাতের বেলা মনে মনে লেখা চিঠিতে সে কত কথাই না লিখেছিল ৷ আর এখন দিনের আলোয় যখন সত্যি সত্যি মাকে সে চিঠি লিখতে বসেছে, তখন কিন্তু আর অত কথা লেখা হয় না ৷ সংক্ষেপে গুছিয়ে, মা যেন আহত না হন, এমন কায়দা করে চিঠিটা লিখতে হয় ৷ মানুষের মনের কথা আর মুখের কথাই এক হয় না, মনের কথা আর চিঠির কথা এক হওয়া তো আরো অসম্ভব ৷
চিঠি পেয়ে মা চিন্তিত হন ৷ আজাদ লিখেছে, ওখানকার খাবার খুব খারাপ ৷ কত খারাপ ? হায়! আমার ছেলে ভাত পছন্দ করে ৷ করাচিতে এখন সে ভাত পাবে কোথায় ? মাছ পাবে কোথায় ? আর দ্যাখো, তিনি নিজে কত রাঁধতে পছন্দ করেন ৷ কতজনকে রেঁধে রেঁধে এই জীবনে খাইয়েছেন ৷ আর তাঁর নিজের ছেলে ভাতের জন্যে আনচান করছে ৷ তাঁর দুঃখের যেন সীমা-পরিসীমা থাকে না ৷ আবার তিনি শাসন করেন নিজের মনকে ৷ আজাদ করাচি গেছে পড়তে, ভালো রেজাল্ট করতে, ভাত-মাছ খেতে নয় ৷ বিদেশে গেলে কষ্ট তো হবেই ৷ মহানবী (সা:) বলেছেন, জ্ঞানার্জনের জন্যে সুদূর চীন দেশে হলেও যাও ৷ আরব দেশ থেকে চীন দেশে কেউ গেলে চায়নিজ খাবার দেখলে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে ৷ কিন্তু তবু তাকে যেতে হবে ৷ কষ্ট স্বীকার করতে হবে ৷ কারণ সে গেছে এল্ম তালিম করতে ৷
আর দ্যাখো তো কাণ্ড ৷ ওরা নাকি উর্দুতে পড়াবে ৷ উর্দু তো ছেলে আমার একদমই জানে না ৷ কেন বাবা ইংরেজিতে পড়াতে পারো না ? আজাদ খুব ভালো ইংরেজি জানে ৷
এইসব সাত-পাঁচ ভাবেন আর তিনি লেগে যান চাল কুরে আটা বানাতে ৷ তাঁর সঙ্গে যোগ দেয় বাসার আর মেয়েরা ৷ উরুনগাইনে ভেজা চাল গুঁড়ো করা চলে ৷ বেরিয়ে পড়ে শাদা আটা ৷ তারপর সেই আটা নিয়ে সাফিয়া বেগম বসে যান পিঠা বানাতে ৷ বাঙালি পিঠা ৷
মা এখন তক্কে তক্কে থাকেন, কে কখন করাচি যাবে ৷ তার হাত দিয়ে তিনি পিঠাটা, মিষ্টিটা পাঠিয়ে দেন ৷ পিঠা খেয়ে আর বন্ধুদের খাইয়ে ছেলে চিঠি লেখে, ‘মা তোমার পিঠা খেয়ে আমার বন্ধুরা কত প্রশংসাই না করেছে ৷’ সেই চিঠি পড়ে মায়ের মন প্রশান্তিতে ভরে যায় ৷ যাক, ছেলে তাঁর পিঠা খেয়েছে, আর শুধু খায়নি, বন্ধুবান্ধবদেরও খাইয়েছে ৷ আর ওরা, মাউড়ারা তাঁর বাঙালি পিঠার প্রশংসা করেছে ৷