"ব্লু হোয়েল" গেমে ‘আসক্ত হয়ে সম্প্রতি আত্মহত্যা’ করেছে বাংলাদেশি এক কিশোরী। তার নাম অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা। পড়াশোনায় খুব মেধাবী ছিল সে। রাজধানীর ওয়াইডব্লিউসিএ হায়ার সেকেন্ডারি গার্লস স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল। সেখানে সব সময় মেধাতালিকায় প্রথম ছিল স্বর্ণা। এরপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় ফার্মগেটের হলিক্রস স্কুলে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত পড়ছিল অষ্টম শ্রেণিতে।
রাজধানীর ধানমণ্ডির সেন্ট্রাল রোডের ৪৪ নম্বর বাসার ৫বি ফ্ল্যাটের বাসা থেকে গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে স্বর্ণার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। এর পর থেকেই তার পরিবারের সন্দেহ যে তাঁদের মেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর ‘ব্লু হোয়েল’ গেমসে আসক্ত হয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
"ব্লু হোয়েল গেইমটা আসলে কি?
‘Blue Whale’ যেই গেম খেললেই মৃত্যু অনিবার্য অ্যাপ স্টোর, প্লে স্টোর, ইন্টারনেট বা গুগল কোথাও খুঁজে পাবেন না এই গেম, খুঁজে পেতেইপল্প পারেন কারো পাঠানো কোনো গোপন লিংকের মাধ্যমে । এটি একটি সুইসাইড গেইম
অর্থাৎ গেম খেললে মৃত্যু অনিবার্য।
‘ব্লু হোয়েল’ বা Blue whale এর অর্থ নীল তিমি। নীল তিমিরা মৃত্যুর আগে সাগরের তীরে উঠে আসে – তারা আত্মহত্যা করে বলে অনেকের ধারণা! একারণেই গেমের নাম রাখা হয়েছে ‘Blue whale’ বা নীল তিমি ।
গেমনি বাধ্য করে তার ইনস্টলকারীকে সবগুলো স্তর খেলার জন্য। ‘ব্লু হোয়েল’ গেমটি ৫০ টি লেভেলে বিভক্ত। F57 নামক রাশিয়ান হ্যাকার টিম গেমটি তৈরি করে। ২০১৩ সালে তৈরি হয়েছিলো গেমটি, কিন্তু ২০১৫ সালে VK. com নামক সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল জনপ্রিয়তা পায় এবং প্রচুর ডাউনলোড হয় গেমটি। ফিলিপ বুদেকিন নামক রুশ হ্যাকার যে কিনা সাইকোলজির ছাত্র ছিলো এবং ভার্সিটি থেকে বহিষ্কার হয়েছিলো – তার মাথার বুদ্ধি থেকেই জন্ম নেয় এই গেমটি। রাশিয়ান আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতারের পর সে জানায় হতাশাগ্রস্হদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্যই সে গেমটি বানিয়েছে। হতাশা গ্রস্হদের পৃথিবীত বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।
রাশিয়ায় এ গেম খেলে মৃতের সংখ্যা ১৫১ জন, এবং রাশিয়ার বাইরে মারা গেছে ৫০ জন। জুলিয়া ওভা ও ভের্নিকা ওভা নামক দুই বোন প্রথম এই গেইমের শিকার। গেমটির ৫০ তম লেভেলে গিয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে ওরা
সুইসাইড করেছিলো। জুলিয়া ওভা মৃত্যুর ঠিক আগে সোশাল নেটওয়ার্কে নীল তিমির ছবি আপলোড দিয়ে লিখেছিলো – ‘The end!’ গেমটি মূলত একটি ডার্ক ওয়েভের (dark wave) গেম। ডার্ক ওয়েভ হলো ইন্টারনেটের অন্ধকার
জগৎ। মনে রাখবে- গেমটি আপনি একবার ডাউনলোড করলে আর কখনোই আনইনস্টল করতে পারবেন না। গেমটি আপনার ফোনের সিস্টেমে ঢুকে আপনার আপনার আই পি এড্রেস, মেইলের পাসওয়ার্ড, ফেসবুক পাসওয়ার্ড কনট্যাক্ট লিস্ট, গ্যালারী ফটো এমনকি আপনার ব্যাংক ইনফর্মেশান! আপনার লোকেশান ও তারা জেনে নিচ্ছে! ‘ব্লু হোয়েল’ গেম ওপেন করা মাত্র আপনাকে একজন এডমিন পরিচালনা শুরু করবে। আপনাকে জিজ্ঞেস করবে – ‘গেমটি খেলা শুরু করলে আপনি কোনোভাবেই এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না, আপনি সর্বশেষে মৃত্যু বরণও করতে পারেন, আপনি কি চ্যালেন্জ গ্রহন করতে আগ্রহী?’ আপনি ইয়েস বা নো অপশনের মধ্যে ‘ইয়েস’ অপশন ক্লিক করা মাত্রই পা দিয়ে দেবেন মৃত্যু ফাঁদে। গেমটির প্রথম দশটা লেভেল খুবই আকর্ষনীয়। ইউজার এডমিন কিছু মজার মজার নির্দেশনা দেন – যেমন রাত তিনটায় ঘুম থেকে উঠে হরর ছবি দেখা, চিল্লাচিল্লি করা, উঁচু ছাদের কিনারায় হাঁটাহাঁটি করা, পছন্দের খাবার খাওয়া ইত্যাদি নির্দেশনা দিতে দিতে এডমিন হাতিয়ে নেবেন আপনার পার্সোনাল ইনফরমেশন। প্রথম দশ টা লেভেল পার করার পর আপনাকে তৈরি করা হবে পরবর্তী দশটি লেভেলের জন্য। পনেরো লেভেল পর্যন্ত চলবে আপনার ইনফরমেশান হাতানোর কাজ! পনেরো লেভেলের পর আপনাকে কঠিন মিশন দেয়া শুরু হবে! যেমন অ্যাডমিন আপনাকে বলতে পারে আপনার হাতে ব্লেড দিয়ে নীল তিমির ছবি আঁকুন! প্রথম বিশটা চ্যালেন্জ অতিক্রম করার পর অ্যাডমিন তার কৌশল পরিবর্তন করতে শুরু করে। আপনি টেরই পাবেন না প্রথম বিশ ধাপে সংগ্রহ করে ফেলা আপনার তথ্যের উপর ভিত্তি করে আপনাকে মোহাক্রান্ত বা হিপনোসিস পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু করা হবে। আপনি তখন ভাববেন এই গেম ছাড়া আপনার বেঁচে থাকা অসম্ভব। আপনাকে শীতের দিনে খালি গায়ে ঘুরতে বলা হবে, বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করা, বন্ধুর মোবাইল চুরি করা, আপনার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটার সাথে দুর্ব্যবহারের মিশন দেয়া হবে আপনাকে! আবার এসবের প্রমাণের ছবি বা ফটো এডমিনকে পাঠাতে হবে আপনার! এভাবেই কৌশলে বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের থেকে কৌশলে আলাদা করে ফেলা হবে আপনাকে এবং আপনি পৌঁছে যাবেন পঁচিশ লেভেলে! পঁচিশ লেভেলের পর নির্দেশনা আসবে মাদক বা ড্রাগ নেবার! এভাবেই সম্মোহিত করে করে আপনাকে তিরিশ লেভেল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে।
তিরিশ তম লেভেল আপনি অতিক্রম করার পর গেম এডমিন হঠাৎ আপনার সাথে একটু চিট শুরু করবে! ৩১ তম লেভেল আনলক করবে না, এদিকে আপনি হয়ে উঠবেন ক্রেজী! তারপর কিছুদিন আপনাকে সারপ্রাইজ দিয়ে হঠাৎ এডমিন – বলবে একত্রিশ তম লেভেল আনলকড! আপনার নগ্ন ছবি চাওয়া হবে এই স্তরে! আপনি হিপনোসিস ও মাদকের কারণে নিজের নগ্ন ছবি পাঠাতেও চিন্তা করবেন না, ড্রাগ নেবার র মাত্রা বাড়াতে থাকবেন আপনি! এরপর নির্দেশনা আসবে আপনার ভালোবাসার মানুষের সাথে সেক্স করে গোপনে ছবি তুলে আপলোড করতে বা নিজের
শরীরে একাধারে শ খানেক সুঁই ফোটাতে এবং ফটো আপলোড করে পাঠাতে। এভাবেই চলে যাবেন আপনি চল্লিশ তম লেভেলে!
এবার আপনি ভীত হয়ে গেমার টিমকে অনুরোধ করবেন আপনাকে মুক্তি দেবার জন্য! আপনি কাঁদবেন , হাতজোর করবেন, চাইবেন গেমটি আনইনস্টল করার জন্য! তখন শুরু হবে ব্ল্যাকমেইলিং! গেমার টিম বা এডমিন তখন আপনারই পাঠানো সকল তথ্য ফাঁস করে দেবার হুমকি দেবে, আপনি বাধ্য হয়ে প্রবেশ করবেন একচল্লিশ তম স্তরে! একচল্লিশ থেকে ঊনপন্চাশ তম লেভেলে আপনি প্রচন্ড হতাশ আর মাদকাসক্ত হবেন……. পঞাশ তম স্তরে আপনাকে মুক্তির শর্ত দেয়া হবে! বলা হবে আপনাকে নিজের শরীরে অ্যানাসথেসিয়ার ড্রাগ ক্যাটামিন পুশ করে তাদের কে ছবি পাঠাতে এবং নিশ্চিত দশ তলার চেয়েও উঁচু কোনো ছাদের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে যদি সেলফি আপলোড দিতে পারেন তবে আপনি মুক্ত! আপনি সেটা পারবেন না আর, কারণ শরীরে পুশ করা ক্যাটামিন আপনার মস্তিষ্কে চলে যাবে ততোক্ষণে! আপনি মোবাইলের স্ক্রীণে তখন নির্দেশ আসবে – ‘ নিচের দিকে তাকাও! লাফ দাও, মুক্তি পাও!’ আপনি মুক্তি পেতে গিয়ে আত্মহত্যা করবেন!
এই ব্লু হোয়েল গেমটিতে ব্যবহার করা হয়েছে চমৎকার গ্রাফিক্স, ব্যাক গ্রাউন্ড মিউজিক ভীষণ করুন! All i want ও Ranway গানের মিউজিক ব্যবহার করা হয়েছে। দুটো মিউজিক শুনলেই শরীরের রক্ত হীম হয়ে যাবে! (সংগৃহীত)
‘বলা হয় যে এই গেমসটি আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে। অর্থাৎ যারা এই গেমসে আসক্ত হয় ধারণা করা হয়, তারা একসময় আত্মহত্যা করবেই। সমাজের সঙ্গে, অভিভাবকের সঙ্গে এবং যারা গেমস ব্যবহার করছে, সেই সন্তানদের সঙ্গে কিন্তু একটি বড় ধরনের গ্যাপ রয়েছে। কাজেই আমাদের আইসিটি মন্ত্রণালয় আছে, তারা এ বিষয়টি নিয়ে একটি নীতিমালা করবে। আমাদের দেশের নাগরিকদের ইন্টারনেটের ব্যবহার বা এক্সেস কতটুকু হবে, এটা মনে হয় রাষ্ট্রের এখন বেঁধে দেওয়ার সময় হয়েছে। সাধারণ জনগণ কোন কোন অ্যাপস, সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করতে পারবে, তার একটা নীতিমালা করতে হবে। এমন ঘটনার পরে সারা দেশে কিন্তু একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে যেতে পারে। কাজেই সরকার ও অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। আর সারা দেশে স্থানীয় নেতা, ধর্মীয় নেতা ও শিক্ষকদের মাধ্যমে এই সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল ও কলেজের তরুণরা বেশি আসক্ত হয়। এই গেমসের মূল বিষয় হলো নিজের প্রতি নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। সে কারণে আসক্ত ব্যক্তিকে ফেরানো কঠিন। পরিবার যেন প্রত্যেককে হাসিমাখা একটি পরিবেশ দেয়। তবেই প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সুন্দর দেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।
"ব্লু হোয়েল" মূলত গেমস না, একজন ক্যাপ্টেন পেছন থেকে এটি পরিচালনা করে। এর মোট ৫০টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। ৫০তম ধাপে গিয়ে বলা হয়, আত্মহত্যা করতে। আর প্রতিটি ধাপেই ব্যবহারকারীকে একটি করে চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়। কোনো মানুষ এ ধরনের ঘটনার শিকার হোক বা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকুক, এটা কেউ চায় না। আমাদের এখানে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়ে যদি এটি ঢুকে, তবে জাতীয়ভাবে এর গেটওয়ে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ভারতে এরই মধ্যে যেসব এলাকায় এর লিংক আছে, তা মুছে দেওয়া হয়েছে বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের অবশ্যই এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ, ইন্টারনেটের গেটওয়ে সরকারের হাতে। আমরা শুধু সচেতনতা বাড়াতে পারব। এটি ব্লক করে দেওয়ার চাবি সরকারের হাতে।’