মৃত্যুর দুই শ বছর পর এখনো দুনিয়া চাইছে তাঁকে বুঝতে। মার্ক্সের সময়ে ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা বাংলা নিয়ে খুব একটা ভাবেননি। মার্ক্স ভাবিত ছিলেন। প্রমাণ তাঁর এথনোলজিকাল নোট বুকস। জীবনসায়াহ্নে তাঁর মনে হয়েছিল, মানবসমাজ তথা জাতিপুঞ্জ বিষয়ে কাজ বাকি রইল। তাই অন্যান্য ভারতীয় ভাষার মধ্যে বাংলার প্রতি উৎসাহী হলেন। শিখলেন ৫ হাজারেরও বেশি শব্দ। বাংলার বস্ত্রশিল্প ও কৃষিতে তারা যে বিপর্যয় এনেছিল, তারই ফল ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে কোটি মানুষের মৃত্যু। মার্ক্সের ভাষায়, ‘বাংলার সবুজ প্রান্তর তাঁতিদের হাড়গোড়ে শ্বেতশুভ্র হয়ে গেছে।’
১৮৫৭ সালের সিপাহি যুদ্ধ যে জাতীয় যুদ্ধ, সে জ্ঞান টনটনা বলে এর নাম দিলেন, ‘প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধ’। ১৮৭১ সালে কলকাতা থেকে কোনো এক যুবক বাংলার শ্রমিকশ্রেণির দুর্দশার কথা জানিয়ে তাঁকে চিঠি লেখেন। তিনি উত্তর দেন। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জবানিতে মার্ক্সের কথা পড়ি, ‘বাংলার মানুষ সরলরেখা আঁকতে জানে না। তাই এখানকার ঘরবাড়ি, সড়ক ও জমির আল বিশুদ্ধ সরলরৈখিক নয়।...একটি মাদুর, কয়েকটি মাটির বাসন আর কাঁথাই বেশির ভাগের সম্বল।’
এই মার্ক্স দরদি। রোমান কবি পেরেন্সের মতো বলেন, ‘যা কিছু মানুষের, আমি তাতেই জড়িত।’ কিন্তু মানবপ্রেমই তাঁকে বড় করেনি। তিনি আধুনিক জগতের নিয়ম আবিষ্কার এবং তাকে বদলানোর শাস্ত্র তৈরি করছিলেন। দৈব নয়, রাজরাজড়া নয়, মানুষকেই তিনি ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু সে-ই তো নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। বিচ্ছিন্নতা ও শ্রমদাসত্বে সে বন্দী। এই বন্দী মানুষটাকেই শ্রমিক-কৃষক-ক্রেতা বানিয়ে শুষে নিচ্ছে পুঁজিবাদ। যে বুর্জোয়া পুঁজিপতি-ব্যবসায়ী-ব্যাংক মালিকেরা পুঁজিবাদ চালাচ্ছে, তারাও বিপদে। তাদের অবস্থা টানেলে শত মাইল বেগে ছুটে চলা গাড়ির চালকের মতো, থামলেই পেছনের গাড়ির ধাক্কায় চুরমার হয়ে যেতে হবে, উন্মাদের মতো ছুটতে থাকলে সংঘাতে ধ্বংস অনিবার্য।
ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলসের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা কমিউনিস্ট ইশতেহারে এই পরিণতির হুঁশিয়ারি ছিল। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩০ আর তিনি লেখেন, অল দ্যাট ইজ সলিড মেলটস ইনটু এয়ার, সত্য ও সারবান সবকিছু হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। দেশ-মানচিত্র, প্রেম-পরিবার, সমাজ-সভ্যতা—সব পুঁজির তাপে চরিত্র হারাবে, মানুষ হবে মেশিনের দাস। বিশ্বায়ন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ফেসবুক কি তার সাক্ষ্য দিচ্ছে না? তাই তাঁর ‘পুঁজি’ বইটি এখন বেশি প্রাসঙ্গিক। পুঁজির যে ডিএনএ তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, তার বিবর্তন এখন অনেকটা
মানুষ সত্যিই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। এই হারিয়ে যাওয়া মানুষের গল্পই বলে হলিউডি সিনেমা ম্যাট্রিক্স (১৯৯৯)। ছবির নায়ক নিওর কাছে রহস্যময় একদল লোক আসে। তারা বলে, তুমি যাকে জীবন ভাবছ, তা আসলে একটা যান্ত্রিক খোয়াব। তোমার আসল অস্তিত্ব বন্দী আছে বিশাল এক জালের ভেতর। তোমার দেহ সেখানে ব্যাটারির মতো করে সিস্টেমকে শক্তি জোগাচ্ছে। তোমার জীবন আসলে একটা বিভ্রম (মার্ক্সের ভাষায় ফলস কনশাসনেস বা ছদ্মচেতনা)। তারা নিওকে একটা লাল বড়ি খেতে দেয়। সেটা খেয়ে তার ঘোর কাটে। ১৯৯৯ সালের সিমুলেশন গেম থেকে বেরিয়ে ২০০ বছর পর অর্থাৎ ২১৯৯ সালের সত্যিকার বাস্তবতায় নিও অবতীর্ণ হয়। (মার্ক্সের জন্মের ২০০ বছরের সঙ্গে নিওর ২০০ বছর পরের পৃথিবীর মিলটা কি নিছক কাকতাল?) সে দেখে, মানব প্রজাতি মেশিনের দাস, প্রত্যেক মানুষই আজন্ম ‘ম্যাট্রিক্স’ নামের জটাজালে বন্দী। তাদের মগজে খেলানো ১৯৯৯ সালের পৃথিবীর জীবনকেই তারা ভাবছে বাস্তব। তাদের জীবনীশক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো একটা ‘পাওয়ার হাউসের’ জ্বালানি হিসেবে।
মার্ক্সের দর্শন থেকে যে মতবাদ তৈরি হয়েছে, তা ব্যর্থ হয়েছে। দর্শন আর মতবাদ এক নয়। কোনো দর্শন থেকে অনেক মতবাদ আসতে পারে, একটা মতবাদ বা পথ ভুল হলে মানুষ আরেকটা পথ নেবে, যদি দর্শনটা তারা জীবন্ত রাখতে পারে। এই দর্শনও কোনো ধ্রুব সত্য না। মার্ক্স তাঁর সময়ের মানুষের জানা জ্ঞানের সাহায্যে চিন্তাধারা তৈরি করে দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। দুনিয়াকে বদলাতে যাঁরা চান, সেই মার্ক্স-অনুসারীদের গোঁয়ার্তুমি ছেড়ে আজকের দুনিয়ার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সাহায্যে নজরটাকে পরিষ্কার করে নিতে হবে। মার্ক্স যেমন বলেন, শিক্ষককেই আগে শিক্ষিত হতে হয়, যে মুক্তির নেতা হবে, তাকেই আগে মুক্ত হতে হবে।