বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১
Smoking
 
ভি. এস. নাইপল এর ইতিকথা
প্রকাশ: ০৯:৪৮ am ১৯-০৯-২০১৮ হালনাগাদ: ০৯:৪৬ am ২৩-০৯-২০১৮
 
 
 


মানসম্পন্ন মার্কিন দৈনিক ইউইয়র্ক টাইমসের ভাষায় ‘তিনি ছিলেন বিতর্কের চলমান বস্তা।’ এডওয়ার্ড সাঈদ ও চিনুয়া আচেবের মতো বিদগ্ধ উত্তর-ঔপনিবেশিক বেত্তাদের কাছে নাইপল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষের স্বনিয়োজিত সমর্থনকারী মাত্র। ১৯৯৪-এ প্রকাশিত 'Representation of the Intellectual' গ্রন্থে সাঈদ লেখেন ‘নাইপলের অনৈতিকতার চরম বহিঃপ্রকাশ এই যে, তিনি পশ্চিমা নিষ্পেষণের সচেতন ওকালতির দায়িত্ব নিয়েছেন।’ জীবিতকালে কনরাড, ডিকেন্স এবং টলস্টয়ের সাথে তুলনীয় নাইপলকে চিনুয়া আচেবে তার 'Home and Exile' গ্রন্থে তুলাধুনা করেছেন। কনরাড ও নাইপলের মতো লেখকের কাছে আফ্রিকা শুধু একটি বর্ণবিদ্বেষী চোখে দেখা অভিশপ্তভূমি মাত্র। আর নাইপল অঙ্কিত ইসলামের চিত্র তো সালমান রুশদী ও উইলিয়াম ডার্লিম্পলদের কাছেও অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। ১৯৯০-এ নাইটহুড পাওয়া নাইপল বর্ণবিদ্বেষী, নারীদ্বেষী, পুরুষতন্ত্রের নির্লজ্জ সমর্থনকারী ও ইসলামবিরোধী হিসেবে নানাভাবে নিন্দিত। এক সময়ের বন্ধু পল থুরোর মতে নাইপল ‘এক কুন্দলে বুড়ো’ মাত্র!

সকল বৈপরীত্যের মধ্যেও ভি. এস. নাইপল অতুলনীয় তার অনুপম রচনারীতি, অনুকরণরহিত বর্ণনারীতি ও মার্জিত রসবোধের জন্য। নাইপল সচেতনভাবে বিতর্কিত, কিন্তু উপেক্ষণীয় নন।

এই দ্বিধান্বিত নাইপল পাঠ আমাদের কাছে পরিষ্কার করে নাইপলের ‘অন্ধকার জগত’কে। এই নামে তার সমধিক খ্যাত ভ্রমণকাহিনী ‘এ্যান এরিয়া অব ডার্কনোস’ এ যেমন আমরা দেখি নাইপলের মনোভূবন- ঘৃণা ও ভালোবাসা, সহানুভূতি ও উপেক্ষা, আকর্ষণ ও স্যাডিজমের সাংঘর্ষিক সহাবস্থান। প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়াট ইট ইজ’ এ অসাধারণ সততার সাথে নাইপলীয় প্রদোষ উন্মোচিত করেছেন নাইপলের সম্মতি নিয়েই। আমরা শিউরে উঠি, কিভাবে নাইপল তার প্রথম স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া হেলকে বছরের পর বছর নির্যাতন করেছেন। নাইপলের রহস্যময় মনোভূমি উন্মোচিত হলে আমরা বুঝি বাবা শ্রীপসাদ নাইপলের ব্যর্থতাবোধ, সাফল্যের জন্য আকাঙ্ক্ষা, ত্রিনিদাদের স্বল্প পরিসর উৎকেন্দ্রিক জীবনের ক্ষোভ, ইংল্যান্ডে প্রথম জীবনের তীব্র দারিদ্র্য ও উপেক্ষা সবকিছু মিলে নাইপলের মাঝে এক জটিল মোহনবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে যে, কিং লীয়ারের মতো পাগলের মতো একটু সম্মান, এক টুকরো জমি ও একটি অবস্থান তৈরি করতে চেয়েছে মাত্র। সারা জীবন নাইপল তার অকালপ্রয়াত বাবার পরিচয়হীনতার গ্লানি বয়ে বেড়িয়েছেন, আর ত্রিনিদাদ যেন তার কাছে বুড়ো নাবিকের গ্রীবায় ঝোলানো অ্যালবাট্রস। মাকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন ‘ত্রিনিদাদ বড় সংকীর্ণ। মূল্যবোধ ত্রুটিপূর্ণ আর লোকগুলো সংকীর্ণমনা।’ অথচ এই ত্রিনিদাদকে নিয়ে লেখা ‘দ্য মিগুয়েল স্ট্রিট’ ‘দ্যা মিস্টিক ম্যাসুর’ ‘এ হাউস ফর মি. বিশ্বাস’ তাকে জগৎ জোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে। (শুধু ঘৃণা দিয়ে এই সৌধ নির্মাণ অকল্পনীয়, ভালোবাসা ও সংবেদনশীলতার বন্ধন যদি না থাকে)। ভি. এস. নাইপল আসলে শেকড়চ্যুত মানুষের অন্তর্জগতকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন উত্তর-উপনিবেশের জতুগৃহে তাদের স্থাপন করে, যেখানে ‘এ বেন্ড ইন দি রিভারের’ সলিমের মতো বাস্তুহারারা বৃথাই নোঙ্গর খুঁজে মরে। ব্যক্তিজীবনে যতই অপূর্ণতা থাক, সাহিত্যকর্মে নাইপল অকপটভাবে জীবনভর পরিব্রাজক; ১৯৬৪ সালে ‘এ্যান নরিয়া অব ডার্কনেস’-এ নাইপল খোলামেলাভাবেই স্বীকার করেছেন-

‘এক বছরে আমি মেনে নিতে পারিনি ভারতকে। ভারতের সাথে আমার বিচ্ছেদকে আমি মানতে শিখেছি- অতীতশূন্য, পূর্ব পুরুষের নামশূন্য, এক উপনিবেশি উদ্বাস্তু হিসেবে।’

সত্যানুসন্ধানকেই আজীবন জীবনসংগ্রামী ভি. এস. নাইপল তার সাহিত্যকর্মের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’। অপ্রিয় ও প্রথাবিরুদ্ধ সত্যকে সন্ধান করার যে ব্রত ভি. এস. নাইপল তার জীবনের মোক্ষ হিসেবে নিয়েছিলেন তা যে অনেক শত্রুতা, মতান্তর ও মর্মান্তরের জন্ম দেবে তা সহজেই অনুমেয়। আলদ্যস হাক্সলির 'The Roots' উপন্যাসের নায়কের মতোন ত্রিনিদাদীয় ব্রাহ্মণপুত্র নাইপল ১৯৬৪ সালে ভারতে পিতৃভূমি সন্ধানে এসে জানলেন এই ভারত তার কল্পনার আদর্শভূমি থেকে বহুদূরে যেখানে তার কোনো ঠাঁই নাই। সত্তর দশকে আফ্রিকায় আর আশির দশকে মধ্যপ্রাচ্য আর মালয় উপদ্বীপের মুসলিম দেশগুলো ভ্রমণের ফসল- কাহিনীগুলোতে তার উন্নাসিকতা, উৎকেন্দ্রিকতা আর চরম নৈরাশ্য বিধৃত। এই স্থান সন্ধান তার মানসিক পটভূমি অধ্যায় এক সবিশেষ প্রেক্ষাপট। সাহিত্যবেত্তা আলফ্রেড কাজিনের মতে ‘আজকের দিনে, আর কেউই মনে হয় না গদ্য ও উপন্যাসে নির্বাসিত কণ্ঠ এতটা জোরালোভাবে নাইপলের মতো ধরে রেখেছেন।’ একবিংশ শতাব্দীর এই সময়েও ভি. এস. নাইপল তার মহৎ উপন্যাস- ‘এ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’, ‘দ্যা মিমিক মেন’ ‘এ বেন্ড ইন দ্যা রিভার’ ‘হাফ আ লাইফ’ ‘দ্যা এনিগমা অব অ্যারাইভাল’-এর মতো মহৎ সাহিত্য নিয়ে আমাদের বিস্মিত, চিন্তাগ্রস্ত ও মোহাবিষ্ট করে রাখেন।

রাজনৈতিকভাবে ভি. এস. নাইপল রক্ষণশীল, পশ্চিমা মূল্যবোধে বিশ্বাসী হলেও সাহিত্যিক হিসেবে আদ্যন্ত সত্যনিষ্ঠ। এমনকি চরম নাইপলদ্বেষী এডওয়ার্ড সাঈদও মনে করেন তার বিশ্বাস ও ভ্রান্ত আদর্শ ‘মানুষকে নাইপলকে প্রতিভাময় সাহিত্যিক হিসেবে ভাবা থেকে বিরত রাখতে পারবে না। ব্যক্তি নাইপলের সকল বৈপরীত্য, অসংলগ্নতা ও উন্মাসিকতা নিয়েও সাহিত্যিক ভি. এস. নাইপল চিরঞ্জীব।’ 

 
 

আরও খবর

Daraz
 
 
 
 
 
 
 
 
©ambalanews24.com | Developed & Maintenance by AmbalaIT