হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। রাজধানীর হাসপাতালগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন স্বজনেরা। প্রচণ্ড জ্বর, বমি, গা ব্যথা এবং কারও কারও ক্ষেত্রে হাতে-পায়ে ফুসকুড়ি কিংবা র্যাশ ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রায় প্রতিদিনই রক্তের খোঁজে ছুটছেন স্বজনরা। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে কীভাবে দূরে থাকা যায়, কী করে সহজে প্রতিকার পেতে পারেন আক্রান্তরা—এ নিয়ে অনেকেই চিন্তিত ও দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে নিজেদেরই সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত (৮ সেপ্টেম্বর) হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ৩৪৯১ জন। এ সময়ে মারা গেছেন ১১ জন। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন (ভর্তি) আছেন ২৪৭ জন। আগস্ট মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ১৬৬৬ জন রোগী। আর ১ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ৮ দিনে ৫৭৫ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জুলাই মাস থেকে এই রোগের প্রকোপ দ্রুত বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০১৫ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিল। ওই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ২৬৭৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। ২০১৬ সালে দেশে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তখন মারা যায় ১৪ জন।
ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার জানায়, যে ২২টি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের তথ্য নিয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের হিসাব রাখে সরকার, সেগুলোর মধ্যে আছে— ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড, বারডেম, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ, বিজিবি, ইউনাইটেড, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক, ইবনে সিনা, ইসলামি ব্যাংক, স্কয়ার, সেন্ট্রাল, খিদমা, অ্যাপোলো, ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ, উত্তরা আধুনিক, সালাউদ্দিন ও পপুলার হাসপাতাল।
এর আগে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) থেকে বলা হয়, ঢাকায় প্রতি বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। এ সময়কে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম ধরা হয়। এ বছরের জানুয়ারিতে আগাম বৃষ্টি হওয়ায় মশার উপদ্রব আগে থেকেই বেড়ে গেছে।
মুক্তি রহমান (২৪) রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা। সম্প্রতি তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে পরিবারের সদস্যরা তাকে রাজধানীর আল মানার হাসপাতালে নিয়ে যান। বর্তমানে তিনি সেখানকার চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে আছেন। তার প্লাটিলেট ৪০ হাজারের নিচে নেমে আসায়, তাকে নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা। একইসঙ্গে তিনি কোনও খাবার খেতে পারছেন না। যা খাচ্ছেন বমি হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তাকে স্যালাইন দিয়ে তার খাদ্য ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছেন চিকিৎসকেরা।
রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি আছে গীতা অধিকারী ও অঞ্জন রায় দম্পতির কিশোরী সন্তান জয়িতা রায়। তার প্লাটিলেট প্রতিদিনই কমে যাওয়ায় চিন্তিত মা-বাবা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাসমিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের নিয়মিত কাজের অংশই হচ্ছে এডিস মশার সার্ভে করা। আমরা এই সার্ভের রিপোর্ট সিটি করপোরেশনকে দিয়ে দেই, যাতে এডিস মশা প্রতিরোধে সহজে তারা কাজ করতে পারে। গত জানুয়ারি, মে ও আগস্ট মাসের সার্ভে রিপোর্ট ইতোমধ্যেই আমরা সিটি করপোরেশনকে দিয়েছি। এছাড়া, মানুষকে সচেতন করতে আমরা সংবাদপত্রে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিচ্ছি।’
অধ্যাপক সানিয়া তাসমিন বলেন, ‘ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্টের জন্য আমাদের একটি গাইডলাইন আছে কীভাবে ডেঙ্গু রোগীকে চিকিৎসা দিতে হবে। এটা প্রথম বের হয়েছিল ২০০০ সালে। ২০১৮ সালে এর চতুর্থ সংস্করণ বের করলাম। আমরা চিকিৎসকদের কাছে সফট কপি পাঠিয়ে দিয়েছি। তারপরও বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ যেসব জায়গায় ডেঙ্গু রোগী বেশি ভর্তি হয়, তাদের আইসিইউর চিকিৎসকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছি। নিয়মিত সিটি করপোরেশনের সঙ্গেও মিটিং হচ্ছে। এ সপ্তাহে আমরা একটা বড় ওয়ার্কশপেরও আয়োজন করবো। ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের জন্য আমরা বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু কিট সরবরাহ করছি।’
তিনি বলেন, ‘মশা মারাতো আমাদের দায়িত্ব না। সুতরাং যেসব এলাকায় মানুষ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাদের আমরা সচেতন করছি।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে গাইডলাইন তৈরি করেছি। এটি প্রতিরোধে সবকিছুই করছি।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রোগী এবং তার পরিবার উভয়েই ভুক্তভোগী হয়। তাই নিজের পরিবারের সদস্যদের যেন ডেঙ্গু না হয়, এ ব্যাপারে সবারই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া, আমি আর কোনও উপায় দেখছি না।’
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার দেওয়া স্বাস্থ্যবার্তায় বলা হয়েছে— ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসজনিত জ্বর, যা এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। সাধারণ চিকিৎসাতেই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া সেরে যায়। তবে হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর মারাত্মক হতে পারে। এডিস মশার বংশবৃদ্ধি রোধের মাধ্যমে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধ করা যায়। বর্ষার সময় এ রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে। তাই এ সময় বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে করণীয়
১. আপনার ঘরে এবং আশপাশে যেকোনও পাত্রে বা জায়গায় জমে থাকা পানি তিন দিন পরপর ফেলে দিতে হবে।
২. ব্যবহৃত পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ঘষে ঘষে পরিষ্কার রাখতে হবে।
৩. অব্যবহৃত পানির পাত্র বিনষ্ট অথবা উল্টে রাখতে হবে, যাতে পানি না জমে।
৪. দিনে অথবা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে।
৫. সম্ভব হলে জানালা এবং দরজায় মশা প্রতিরোধক নেট লাগানো, যাতে ঘরে মশা প্রবেশ করতে না পারে।
৬. প্রয়োজনে শরীরের (মুখমণ্ডল ব্যতীত) অনাবৃত স্থানে মশা নিবারক ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে।
৭. ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগে আতঙ্ক নয়—সময় মতো সুচিকিৎসায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগ ভালো হয়।