কক্সবাজার প্রশাসন ও পুলিশের বাধায় রোহিঙ্গাদের জন্য নিয়ে যাওয়া ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে পারেনি বিএনপির প্রতিনিধি দল। পরে কক্সবাজার জেলা বিএনপি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও প্রতিনিধি দলের নেতা মির্জা আব্বাস অভিযোগ করেন, বিএনপি এখানে রাজনীতি করতে আসেনি, আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে এসেছিল। কিন্তু কক্সবাজার প্রশাসন ও পুলিশ সেই ত্রাণ বিতরণে বাধা দিয়েছে। এটি করে সরকার অপরাধ করেছে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, ত্রাণ বিতরণ করে তবেই তারা ঢাকায় ফিরবেন। এদিকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, হাজার হাজার শরণার্থীর মাঝে কোনো দল, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিগতভাবে ত্রাণ বিতরণ করলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে অন্যদের ত্রাণ জমা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনই তা বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিএনপি নেতাদের এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও পুলিশের এমন বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, তারা জানতে পেরেছেন জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। জাতীয় পার্টি পারলে বিএনপিও পারবে ত্রাণ বিতরণ করতে।
প্রতিনিধি দলে থাকা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু গতকাল রাতে জানান, গত মঙ্গলবার বিমানে তারা কক্সবাজার পৌঁছেন। এরপর রাতে হোটেলে বিশ্রাম শেষে গতকাল সকালে তারা কক্সবাজার জেলা বিএনপির কার্যালয়ে যান। তার আগে কার্যালয়ের সামনেই রাখা হয় ত্রাণভর্তি ২২টি ট্রাক। কার্যালয় থেকে ত্রাণসহ কক্সবাজারের উখিয়ার উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ তাদের বাধা দেয়। ড্রাইভারদের কাছ থেকে ট্রাকের চাবি নিয়ে যায় পুলিশ সদস্যরা। পরে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ত্রাণ নিয়ে তারা উখিয়ায় যেতে পারবেন না। ত্রাণ স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জমা দিতে হবে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য নিয়ে যাওয়া বিএনপির ত্রাণ বহরের ২২টি ট্রাক আটকে দিয়েছে পুলিশ। একই সঙ্গে দলটির ত্রাণ দলের নেতা ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে হোটেলে যেতেও বাধা দেয় পুলিশ। বাধা পেয়ে বিএনপির প্রতিনিধি দলটি বেলা ৩টার দিকে জেলা বিএনপি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সংবাদ সম্মেলন থেকে বের হয়ে হোটেলে যাওয়ার পথেই পুলিশ মির্জা আব্বাসের গাড়িবহরকে আটকে দেয়। ত্রাণ বিতরণে বাধা দিয়ে সরকার জঘন্য উদাহরণ সৃষ্টি করল-এমন দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে মির্জা আব্বাস বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলোতে যারা আছে তাদের কোনো গোসল নেই, পানি নেই, খাদ্য নেই। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানবিক বিপর্যয় চলছে। সেখানে গেলে বিএনপি নেতারা তা জানতে পারবেন বলে প্রশাসন ও পুলিশ তাদের যেতে দেয়নি। মির্জা আব্বাস জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিএনপির ত্রাণগুলো সরকারের কাছে জমা দিতে হবে। তারাই সেটা বিতরণ করবে। বিএনপি কখনও তাদের ত্রাণ সরকারের কাছে জমা দেবে না। বিএনপি তো ডিসি ও আওয়ামী লীগের কথামতো চলবে না। বিএনপির ত্রাণ বিএনপির প্রতিনিধি দলই দেবে। সরকার ইচ্ছা করলে বিএনপির ত্রাণ ‘সিজ’ করতে পারে বলেও জানান বিএনপির এই স্থায়ী কমিটির সদস্য। পুলিশি বাধার বর্ণনা দিতে গিয়ে মির্জা আব্বাস বলেন, ত্রাণ দিতে যাওয়ার সময় দেখা গেছে ট্রাক আর চলে না। পুলিশ চালকের কাছ থেকে গাড়ির চাবি কেড়ে নিয়ে চালকদের সরিয়ে দেয়। পরে চালকদের খুঁজে আনলে চাবি ফিরিয়ে দেওয়া হলেও গাড়িবহরের সামনে পুলিশের একটি পিকআপ দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, চিকিত্সার জন্য লন্ডনে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন গত ২৮ আগস্ট নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ সরকার সীমান্তে বর্ডার গার্ড মোতায়েন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে বাধা দিয়েছে। তার মতে, বিএনপি রোহিঙ্গাদের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার পর সরকারপ্রধান রোহিঙ্গাদের কাছে আসতে বাধ্য হয়েছেন। মির্জা আব্বাস বলেন, বিএনপির আগে ত্রাণের এত বড় বহর নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল রোহিঙ্গাদের কাছে আসেনি। বিএনপির আগে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ায়নি, রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেনি। তিনি মনে করেন, সরকার রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখতে পারবে, যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে পারবে না। তিনি বলেন, বিএনপি ৯ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য ত্রাণসামগ্রী নিয়ে কক্সবাজারে এসেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ৯ হাজার পরিবারের খাদ্যসামগ্রী ও সাড়ে ৩ হাজার পরিবারের জন্য প্লাস্টিক সিট। সংবাদ সম্মেলনে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, খালেদা জিয়া বলেছেন, মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে হবে, তাদের আবার নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। যেখানে সবাই মিলে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত সেখানে সরকার বিএনপির ত্রাণ কাজে বাধা দিচ্ছে। বিএনপির এই স্থায়ী কমিটির সদস্য দাবি করেন, গতকালও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণ হয়েছে। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। এক দেশে দুই আইন চলতে পারে না। এরশাদ পারলে মির্জা আব্বাস কেন পারবেন না?
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুুদু, সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম, কেন্দ্রীয় মত্স্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক লুত্ফুর রহমান কাজল, কক্সবাজার জেলা বিএনপির সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামীম আরা স্বপ্না, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের ভূইয়া জুয়েল প্রমুখ।
মির্জা ফখরুলের নিন্দা : গতকাল বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দশম কারামুক্তি দিবস উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় মির্জা ফখরুল রোহিঙ্গাদের জন্য নিয়ে যাওয়া ত্রাণ বিতরণে বাধা দেওয়ার ঘটনার নিন্দা জানান। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে সহায়তা করার জন্য কক্সবাজার প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। সভা চলাকালীন সময়ে ত্রাণে বাধা দেওয়ার খবর মির্জা ফখরুলকে মোবাইল ফোনে জানান প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। পরে মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে বিএনপির কেন্দ্রীয় রিলিফ টিম ২২ ট্রাক রিলিফ নিয়ে গেছে কক্সবাজারের উখিয়ায়। যাওয়ার সময় পুলিশ আটকে দিয়েছে। শুধু ত্রাণসামগ্রীই আটকে দেয়নি, কক্সবাজারে জেলা বিএনপি অফিস পুলিশ ঘিরে রেখেছে। নেতারা অফিস ঘরে আটকা পড়েছেন। তিনি বলেন, ত্রাণ বিতরণে বাধা দেওয়ার ঘটনায় সরকারের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। বিএনপিকে ত্রাণ দিতে বাধা দেওয়ার ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর সরকারের ঘোষণা শুধুই আইওয়াশ। সত্যিকার অর্থে সরকার যদি রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াত তাহলে তারা আজকে বিএনপির রিলিফ টিমকে উখিয়ায় অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে বাধা দিত না। মেডিক্যাল টিম রোহিঙ্গাদের চিকিত্সা সেবা দিয়েছে : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এবং বিএনপি সমর্থক ডাক্তারদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) মহাসচিব ডা. জাহিদ গতকাল রাতে সকালের খবরকে বলেন, বিএনপিকে ত্রাণ বিতরণে বাধা দিলেও তারা কক্সবাজারের উখিয়ায় সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের চিকিত্সা সেবা দিয়েছেন। ডাক্তারদের ২৪টি টিম পৃথক পৃথকভাবে কাজ করেছে।