প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানী ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয় জন্মলগ্ন থেকে শিক্ষা, গবেষণা ও জাতীয়ভাবে অবদানের ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান প্রথম স্থানেই ধরে রেখেছে। দেশের বহু জ্ঞানীগুণী, পণ্ডিত, শিল্পী-সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদের জন্ম হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এ ছাড়া এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের সব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রিয় পাঠক, আপনাকে আমরা আজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পরিচিতি করার চেষ্টা করব।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে স্বাধীন জাতিসত্ত্বার বিকাশের লক্ষ্যে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন শাসকদের অন্যায্য সিদ্ধান্তে পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিবাদের ফসল হচ্ছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ববঙ্গ শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর এ অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর ঢাকার স্থানীয় মুসলিম নেতারা বিশেষ করে ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ।
১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট এবং সে বছরের ডিসেম্বর মাসেই সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাস করে দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০। সৃষ্টির শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। কলকাতার তৎকালীন একটি শিক্ষিত মহল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে। এ ছাড়া ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এর ফলে পূর্ব বাংলার মানুষ হতাশা প্রকাশ করে।
১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সরকারের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্বান জানান। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল এ বিলে সম্মতি দেন। এ আইনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। এ আইনের বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবে ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। সে সময়ে ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রমনা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পূর্ববঙ্গ, আসাম প্রদেশের পরিত্যক্ত ভবনাদি এবং ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনগুলোর সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার এই দিনটি প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
শুরুর কথা
তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। কলা, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদের অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলা, ইংরেজি, শিক্ষা, ইতিহাস, আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারসি ও উর্দু, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত ও আইন।
প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষকসংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগ (ইংরেজি বিভাগ; এমএ-১৯২৩)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অস্থিরতা ও ভারত বিভক্তি আন্দোলনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ দেশের মানুষের আশা উজ্জীবিত হয়। তৎকালীন পূর্ববাংলার ৫৫টি কলেজ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। ১৯৪৭-৭১ সময়ের মধ্যে পাঁচটি নতুন অনুষদ, ১৬টি নতুন বিভাগ ও চারটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। স্বাধীনতাযুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। এতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্রছাত্রীসহ শহীদ হয়েছেন বহুজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে স্বৈরাচার আইয়ুব খানের সরকার প্রবর্তিত অর্ডিন্যান্স বাতিলের জন্য ষাটের দশক থেকে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ওই অর্ডিন্যান্স বাতিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ-১৯৭৩ জারি করে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় এই অধ্যাদেশে পরিচালিত হয়ে আসছে।
অনুষদ
দেশের সর্বপ্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৩টি অনুষদ, ৭৭টি বিভাগ ১১টি ইনস্টিটিউট ও ৫১টি গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে।
শিক্ষক, কর্মকতা ও কর্মচারীর সংখ্যা
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা এক হাজার ৮৮৫ জন। অফিসার সংখ্যা ৯৭৩ জন, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর সংখ্যা এক হাজার ৯৫ জন এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর সংখ্যা দুই হাজার ৪৩৫ জন।
শিক্ষার্থী
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের থাকার জন্য রয়েছে ২০টি আবাসিক হল ও তিনটি হোস্টেল। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা (২০১৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত) ৩৭ হাজার ৬৪ জন। এ ছাড়া পিএইচডি ডিগ্রিতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা রয়েছে এক হাজার ৮৯ জন। এমফিল ডিগ্রিরত রয়েছেন এক হাজার ৬২০ জন। এ ছাড়া এযাবৎ কাল পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন এক হাজার ২৬২ ছাত্রছাত্রী। এবং এমফিল শেষ করেছেন এক হাজার ২১৭ জন। এ ছাড়া ২৮১টি ট্রাস্ট ফান্ড রয়েছে, অধিভুক্ত কলেজ রয়েছে ৯১টি, এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী রয়েছে ৩৫ হাজার ৮৪০ জন এবং শিক্ষক রয়েছে সাত হাজার ১০৩ জন।
কলা অনুষদ
বাংলা, ইংরেজি, ফারসি ও উর্দু, দর্শন, ইতিহাস, আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, সংস্কৃত ও পালি, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা, ভাষা বিজ্ঞান, নাট্যকলা ও সঙ্গীত, বিশ্ব ধর্মতত্ত্ব বিভাগ ।
বিজ্ঞান অনুষদ
পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন, পরিসংখ্যান বিভাগ।
আইন অনুষদ
আইন বিভাগ
বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ
ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, মার্কেটিং, ফিন্যান্স, ব্যাংকিং, হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ও ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ
অর্থনীতি বিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, লোকপ্রশাসন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, নৃবিজ্ঞান, পপুলেশন সায়েন্সেস, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন, উইমেন্স স্টাডিজ ও ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ।
জীববিজ্ঞান অনুষদ
মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অণুজীব বিজ্ঞান, মৎস্যবিজ্ঞান, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ।
ফার্মেসি অনুষদ
ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি, ঔষধ প্রযুক্তি বিভাগ।
ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান অনুষদ
ভূগোল ও পরিবেশ এবং ভূতত্ত্ব বিভাগ।
ইঞ্জিনিয়ারিং এবং টেকনোলজি অনুষদ
ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, ইলেকট্রনিকস এবং কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রযুক্তি, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।
চারুকলা অনুষদ
অঙ্কন ও চিত্রায়ন, গ্রাফিক ডিজাইন, প্রিন্ট মেকিং, প্রাচ্যকলা, ভাস্কর্য, কারুশিল্প, মৃৎশিল্প।
চিকিৎসা অনুষদ
স্নাতকোত্তর চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুষদ, স্নাতকোত্তর চিকিৎসাবিজ্ঞান ও গবেষণা অনুষদ।
ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান ১১টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। তা হলো : শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, পরিসংখ্যান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, নবায়নযোগ্য শক্তি ইনস্টিটিউট, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাশ্রম ইনস্টিটিউট।
আবাসিক হল
বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্রছাত্রীকে কোনো না কোনো হলের সাথে আবাসিক/অনাবাসিক ছাত্রছাত্রী হিসেবে যুক্ত থাকতে হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য ১৫টি এবং ছাত্রীদের জন্য পাঁচটি আবাসিক হল রয়েছে। এ ছাড়া চারুকলা ইনস্টিটিউট ও ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীদের জন্য রয়েছে আলাদা হোস্টেল এবং বিদেশি ছাত্রদের জন্য আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস।
বিশেষ অর্জন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
ঐতিহাসিক স্থান
মধুর ক্যান্টিন, ডাকসু, টিএসসি, অপরাজেয় বাংলা, তিন নেতার মাজার, মীর জুমলার গেট, ডিমিট্রিয়াস, বুদ্ধিজীবী চত্বর, ঐতিহাসিক বটতলা, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, রাজু ভাস্কর্য, স্বাধীনতার সংগ্রাম, শান্তির পায়রা, স্মৃতিময় জগন্নাথ হল।