বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১
Smoking
 
কলম এবং কয়েকটি বর্ণমালা
প্রকাশ: ০৯:৫৮ am ১১-০৯-২০১৮ হালনাগাদ: ১০:৩২ am ১৩-০৯-২০১৮
 
 
 


কালি, কলম, মন—লেখে তিনজন। এটি আপ্তবাক্য নাকি কোনো প্রবাদবাক্য তার হদিস খুঁজে পাইনি। কাউকে প্রশ্ন করেও মেলেনি কোনো সদুত্তর। বাধ্য হয়ে তাই কথাটার উৎস-সন্ধানে ক্ষান্ত দিয়েছি। বাক্যটি অবশ্য আলাদা করে পড়িনি কোথাও। কানে শোনা। প্রথম শুনি ১৯৫৬ সালে, ক্লাস সিক্সে হাইস্কুলের প্রথম ক্লাসে, বাংলার শিক্ষক সেন মশাইয়ের কাছ থেকে। সেন মশাইয়ের আসল নাম ছিল অসিতপদ সেন। তবে সবার কাছে তিনি ছিলেন সেন মশাই। সেন মশাইয়ের বাতিক ছিল শব্দের ব্যুৎপত্তি খোঁজার। ফলে আমাদের বাংলা বইয়ের গদ্য-পদ্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না। মাথা খাটাতেন শুধু ব্যাকরণ নিয়ে। আমাদের ব্যাকরণ বই ছিল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা—মধ্য বাংলা ব্যাকরণ। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সতেরোটা ভাষা জানতেন—এ খবর আমরা তাঁর কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারি। সেন মশাই তখন আমাদের স্কুলের একমাত্র হিন্দু শিক্ষক। বাকিরা দেশত্যাগী। সেন মশাই ও পথ মাড়াননি।

আমাদের তখনকার বাংলা বইয়ে নীতিকথামূলক রচনাই বেশি থাকত। সেন মশাই প্রসঙ্গক্রমে একটা কথাই বারবার বলতেন—এগুলো পড়লে, মনে রাখলে, তোমরা মানুষ হতে পারবে। মানুষের মতো মানুষ হতে পারলে তোমাদের আর কিছু লাগবে না। পাড়া-গাঁয়ের স্কুলের নিরহংকারী, প্রায় বিত্তহীন এক হিন্দু শিক্ষক সেন মশাইয়ের পান খাওয়া মুখ আজও চোখের সামনে ভাসে। মনে পড়ে তাঁর সেই উপদেশমূলক কথা এবং সেই সঙ্গে তাঁর মুখ থেকে শোনা—কালি, কলম, মন—লেখে তিনজন। তো, সেন মশাই সেদিন কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থ তাঁর মতো করে আমাদের বলেছিলেন, ভালো কালি, ভালো কলম এবং সুস্থ মন না হলে লেখাপড়া ভালো হয় না। ব্যাকরণ-পাগল সেন মশাই এর চেয়ে বেশি কথা আমাদের বলতে পারেননি।

সেন মশাইয়ের কথা পুরোটা সেদিন মাথায় ঢোকেনি। ভালো কালি, ভালো কলম পর্যন্ত ঠিক ছিল কিন্তু তার সঙ্গে সুস্থ মন ফিট করতে পারিনি। বস্তুত বয়সের কারণে মনকে আলাদা করে দেখার অবস্থা তখনো আমাদের হয়নি। আমাদের গ্রামীণ স্কুলজীবনে রোমাঞ্চকর দুটো ব্যাপার ছিল। এখনো আছে কি না খোঁজ নিইনি। যা হোক, একটা ছিল গরমের দিনের মর্নিং স্কুল। আরেকটা ছিল রেইনি ডে। টানা বৃষ্টির দিনে ক্লাস হতো না। ছুটি দিয়ে দেওয়া হতো। সেটাই হলো রেইনি ডে। বড়ই আনন্দের দিন ছিল সেটা। তবে সে আনন্দ জুটত কালেভদ্রে।

মর্নিং স্কুলের ব্যাপারটা ছিল নিয়মিত। গরমের ছুটির আগের মাসটায় বসত মর্নিং স্কুল। সে বড় আনন্দময় দিন। তরিতরকারির খোসা ছেলার জন্য এখন যেমন পিলার ব্যবহার করা হয়—সে রকম পিলার আমরা বানাতাম বড় ঝিনুকের তলা ঘষে, আমের খোসা ছেলার কাজে। ঝিনুকটা পকেটেই থাকত। স্কুল থেকে বেরিয়েই যেতাম বাগানে। তারপর পুকুরে। দু-চোখ লাল করে ঢুকতাম বাড়িতে। মায়ের মিষ্টি শাসন খাওয়ার জন্য।

মর্নিং স্কুলের শেষ দিনে দেওয়া হতো সামার ভ্যাকেশন অর্থাৎ গরমের ছুটির নোটিশ। ছুটির মেয়াদ ছিল বড়জোর তেত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ দিন। নোটিশের দিনে সব ক্লাসের সবাই হাজির হতো ফুলের মালা নিয়ে। প্রথম ক্লাস থাকত বাংলার শিক্ষকের। তাই মালা তিনিই পরতেন। তারপর আবৃত্তির পালা। মুখস্থ আবৃত্তি। পরের ইংরেজি ক্লাসেও তাই। ইংরেজি শিক্ষকের কপালে মালা জুটত না। তাতে তাঁদের কোনো আক্ষেপ ছিল বলে মনে পড়ে না। বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের শিক্ষক দিতেন ছুটির দিনের বাড়ির কাজ। যত দিন ছুটি তত পৃষ্ঠা করে বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা। গণিতের বেলায় ছিল ততটা সরল অঙ্ক—আমরা বলতাম সিঁড়িভাঙা অঙ্ক।

ছুটির আনন্দে তখন ‘ঝলমল করে চিত্ত’ অবস্থা। বাড়ির লম্বা কাজকে কোনো কাজই মনে হতো না। প্রথমেই খাতার আয়োজন। সেই পঞ্চাশের দশকে গ্রামে এক্সারসাইজ খাতার নাম তখনো শুনিনি। খাতা বাঁধাই করে দিতেন বাবা। ওপরে বাদামি রঙের মসৃণ শক্ত কাগজের মলাট। আমরা পেনসিল দিয়ে রুল টেনে নিতাম। গণিতের খাতা সাদাই থাকত। বাদামি রঙের মলাটের কাগজকে তখন বলা হতো বাঁশ কাগজ। বইয়ের মলাটও হতো বাঁশ কাগজ দিয়ে। এখন যেমন শিট হিসেবে কাগজ কেনাবেচা হয়, তখন হতো তা হিসেবে। চব্বিশ তায়ে এক দিস্তা। তা, দিস্তা, কাগজ—কোনোটাই অবশ্য আসল বাংলা শব্দ নয়, বৈভাষিক শব্দ। তা, দিস্তা—কাগজের এসব হিসাব বোধ করি এখন বাতিল। বাতিল তো কাগজ শব্দটাও। সবার মুখে এখন পেপার—সেটা খবরেরই হোক, আর লেখার সাদা কাগজই হোক। খাতার কাজ শেষ হওয়ার পর ছিল কালি বানানোর কাজ। সেটাও ছিল ‘প্রকাণ্ড কাণ্ড’। ফাউন্টেন পেন—সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ এর বাংলা করেছিলেন ঝরনা কলম, তখন সম্পন্ন সব গ্রামেও চালু হয়ে গেছে। আমাদের স্কুল তৈরি হয়েছিল ১৮৯৯-তে। অতএব এন্ট্রান্স বা ম্যাট্রিক পাস করা লোক গিজগিজ না করলেও স্কুলপড়ুয়া লোকের অভাব ছিল না। এই রকম বিত্তবান মানুষের বুক পকেটে তখন শোভা পেত ওয়াটারম্যান, পেলিক্যান, পার্কার ফিফটি ওয়ান, শেফার্স ইত্যাদি সব বিখ্যাত কলম। আমাদের বিএবিটি হেডমাস্টার সাহেবের টেবিলে সুদৃশ্য দোয়াতকলম থাকলেও তিনি পার্কার ব্যবহার করার গর্ব প্রকাশ করতেন। আমাদের কপালে ছিল দোয়াতকলম। দোয়াত মনে হয় একালে অচেনা বস্তু ও শব্দ। যা হোক, দোয়াতের কালির জন্য সে সময় পাওয়া যেত সুলেখা বড়ি, তা-ও মুদি দোকানে।

আমাদের গ্রামে তখন একটাই মুদি দোকান। এ কালের ভাষায় তাকে অনায়াসে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বলা যায়। কী সেখানে পাওয়া যেত না? তো, আমাদের সেই মুদি দোকানের লম্বা এক ফালি শোকেসে শোভা পেত পেলিক্যান ৪০০১, পার্কার কুইঙ্ক, শেফার্স স্ক্রিপ—এসব নামের বিশ্বখ্যাত সব কালি। যা ছিল আমাদের নাগালের বাইরে। আমরা সুলেখা বড়ি গুঁড়ো করে মাকে জ্বালিয়ে গরম পানির ব্যবস্থা শেষে দোয়াতে ঢেলে রাখতাম রাতভর। সকালে কালি প্রস্তুত। তাতেই চলত কলমের নিব চুবিয়ে লেখালেখি। কিন্তু তাই বলে কি আমাদের লেখালেখি তখনই শুরু হয়ে যেত? মোটেই না। প্রথম বিশটা দিন তো কেটে যেত ছুটির ঘোরে, আনন্দে, স্ফূর্তিতে। তারপরই আকাশ ভেঙে পড়ত মাথায়। ঘনঘন বজ্রাঘাত। তড়িঘড়ি করে বসা হতো দোয়াত-কলম নিয়ে। দিনে এক পৃষ্ঠা করে লেখার কথা। লিখতাম তিন-চার পৃষ্ঠা করে। তাড়াহুড়োতে ভুল থেকে যেত বিস্তর। তার জেরে ছুটি শেষের প্রথম ক্লাস থেকেই শুরু হয়ে যেত বকাবকি।

লেখার কাজ দিনে দিনেই শেষ করতে হতো। সন্ধ্যায় হারিকেনের টিমটিমে আলোয় কালি, কলম, খাতাকে কিছুতেই এক করা যেত না। কখনো কালি বেশি পড়ে যেত। কখনো দোয়াত যেত উল্টে। তখনই বুঝতে শুরু করেছিলাম জগতে অবিমিশ্র আনন্দ বলতে কিছু নেই। কলম ছিল কাঠের। চেহারা ছিল শৈল্পিক। নানা রঙের। স্টিলের তৈরি লম্বা ছুঁচালো এক নিব আসত ইংল্যান্ড থেকে। দেখতে সুন্দর সেই নিবের কোম্পানির নাম অনেক দিন মনে করে রেখেছিলাম। শেষটায় গেলাম হেরে। পরে এল জাপান থেকে পিতলের তৈরি ভোঁতামুখের নিব। মনে ধরেনি।

আমাদের তৈরি দোয়াতের কালিতে তেমন খোলতাই ভাব আসত না। কালি হলেও তাতে ছিল কেমন মেটেমেটে ভাব। তখন সন্ধান পাওয়া গেল এক টোটকার। কি-না, দোয়াতে কুইনাইন বড়ি গুলে মেশাতে পারলে তবেই কালিতে জৌলুশ আসবে। আমাদের আর পায় কে?

রাইটার পেন এসেছিল ভারত থেকে। অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল এই পেন। আমরাও এই পেনে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পেয়েছিলাম। দাম ছিল সম্ভবত তিন টাকা। ফলে সবার পকেটেই তখন রাইটার পেন। ট্রেনেও তখন রাইটার পেন ফেরি করা হতো। লোহার সিটের মাথায় বাড়ি মেরে মেরে ফেরিওয়ালা বলত, পাথর পেন। হঠাৎ দেখা গেল অনেকের বুক পকেটে কালির দাগ। পেন থেকে বেরিয়ে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে জামার। জানা গেল, রাইটার পেনের নানান রকম নকল বেরিয়ে গেছে। সম্ভবত ১৯৫৮-তে অর্থাৎ ক্লাস এইটে আমার এক সহপাঠীর বুক পকেটে দেখলাম সুন্দর একটা পেন। ক্যাপটা সোনালি-একেবারে সোনার মতোই। নাম গোল্ড ক্যাপ পাইলট। এ রকম পেন তো আগে কখনো দেখিনি। পার্কার শেফার্সের ক্যাপ ধাতব হলেও তা ছিল রুপালি। পেন দেখে আমাদের মাথা খারাপের জোগাড়। ঈর্ষা শব্দটা বইয়ের পাতা থেকে ঢুকে গেল আমাদের বুকের ভেতরে। গোল্ড ক্যাপ পাইলটের দাম রাইটারের চেয়ে অন্তত আড়াই গুণ বেশি। আমাদের অনেকেরই সাধ্যের বাইরে।

এই সময়ে বলপেনও এসেছিল। লাল-নীল। গায়ের রং সাদা। মাথায় লাল-নীল দুই বোতাম। কেন জানি না, এটার ব্যাপারে আমাদের কালে কারও তেমন আগ্রহ জন্মায়নি। পরে যখন ইয়োথ নামের বলপেন এল বছর খানেক পর চীন থেকে—সেটা বেশ সাড়া ফেলেছিল। ইয়োথ পরে সাধারণ পেন হিসেবেও পাওয়া যেত। গোল্ড ক্যাপ পাইলট এসেছিল জাপান থেকে। তো, ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’—হই হই করে চীন থেকে এসে গেল উইং সাং পেন, বডিতে-ক্যাপে নানান রঙের সমারোহ নিয়ে। দামও পাইলটের চাইতে কম। আমাদের অনেকেরই বুক থেকে ঈর্ষার পাথরটা সরে গেল।

রাইটার পেনে ভরতে হতো নিজেদের তৈরি কালি, আলাদা ড্রপার কিনে। দামি কলমের পেটের মধ্যেই ছিল ড্রপার। ছিল নিজ নিজ কোম্পানির কালি। পাইলটেও তাই। উইং সাং সেই পথ অনুসরণ করেই এল। সঙ্গে নিয়ে এল হিরো নামের এক কালি। পার্কার, শেফার্স, পেলিক্যান কালির রং হতো লাল, সবুজ, রয়্যাল ব্লু, জেট ব্ল্যাক। হিরো কালি যুক্ত করল নতুন রং-ব্লু ব্ল্যাক।

গোল্ড ক্যাপ পাইলট উইং সাংয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এঁটে উঠতে পারল না। ক্যাপের বডি মসৃণ হওয়ায় কিছুদিন পর দাগ দেখা দিত। উইং সাংয়ে ওই সমস্যা ছিল না। পরে পাইলট-ভি নামে আরও দামি একটা ব্র্যান্ড আসে পাইলটের। সেটা তেমন জায়গা পায়নি। এখন তো হাতে বলপেন। মঁ ব্লাঁ বলে দামি একটা ফরাসি পেন পেয়েছিলাম প্রবাসী এক বন্ধুর কাছ থেকে, উপহার হিসেবে। সেটা ড্রয়ারেই পড়ে থাকে। কালি ভরার পেন। দেখলেই সেন মশাইয়ের কথা মনে পড়ে। মঁ ব্লাঁ তো দূরে থাক, সেন মশাইয়ের তো কোনো পেনই ছিল না। তাঁর জীবনে কালি ও কলম চিরদিন আলাদাই ছিল। কিন্তু মন ছিল সবকিছুর সঙ্গে।

 

 
 

আরও খবর

Daraz
 
 
 
 
 
 
 
 
©ambalanews24.com | Developed & Maintenance by AmbalaIT