প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “পঁচাত্তরের পর যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারাই নিজেদের আখের গুছিয়েছে। আর সাধারণ মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্র হয়েছে। জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশের সমস্ত উন্নয়ন থেমে যায়। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, জাতির পিতা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে আরো ২৫/৩০ বছর আগেই বাংলাদেশ উন্নত দেশের পরিণত হতো।”
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে এ সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশ পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং দলের মুখপাত্র ড. হাছান মাহমুদ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাতির পিতার মৃত্যুর পর ১৯টা ক্যু হয়েছিল এই বাংলাদেশে। মেধাবি ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে জিয়াউর রহমান তার রাজনৈতিক অভিলাষ পূর্ণ করেছে। পঁচাত্তরের পরে যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারা কখনো এদেশের মানুষকে মাথা উচু করে বাঁচতে দিতে চায় নাই। কিন্তু জাতির পিতা কখনো নিজের কথা ভাবেননি।”
তিনি বলেন, “ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে চেষ্টা হয়েছিল। বাংলার মানুষ কখনো কোনো অন্যায়কে মেনে নেয় নাই।”
শেখ হাসিনা বলেন, “দেশে কোনো মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। আজ তিনটি হচ্ছে। রাজশাহী ও চট্টগ্রামে হচ্ছে। আগামীতে প্রত্যেক বিভাগে একটি করে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় করে দিব। ফ্যাশন ডিজাইন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট করে দিচ্ছি। উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃত্তি দিচ্ছি।”
“ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছি। সবার হাতে এখন মোবাইল ফোন। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে যেন ছেলে মেয়েরা আয় করতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি। ১০টি ভাষায় অ্যাপস তৈরি করে দিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য এ দেশের ছেলে-মেয়েরা উন্নত জীবন পাবে, সুন্দরভাবে বাঁচবে। বাবা-মায়ের কষ্ট যেনো না হয়, সেজন্য প্রি প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনা পয়সায় বই বিতরণ করছি। আমি জানি না, পৃথিবীর কোনো দেশ একসঙ্গে এতো বই দিতে পারে কী না।”
“আজ গ্রামের মানুষের জীবনমান যেভাবে উন্নীত হচ্ছে। ৫ কোটি মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উন্নীত হয়েছে। হতদরিদ্রের সংখ্যা কমিয়ে ১২ ভাগে এনেছি। দারিদ্রের হার ২২ ভাগে নামিয়ে এনেছি। এটা যেনো ৭/৮ ভাগে নেমে আসে সে লক্ষ্যে বাজেট দিয়েছি। জেলা থেকে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা যাতে গড়ে উঠে, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।”
বিদ্যুতের জন্য দেশের মানুষের হাহাকার ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রথমবার সরকারে আসার পর বিদ্যুতের উৎপাদন মাত্র ১৬শ মেগাওয়াট ছিল। সে মেয়াদে সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করেছিলাম।”
বেগম খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “বিএনপি নেত্রী মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পাস করেছেন মাত্র দুই বিষয়ে- অংক ও উর্দুতে। তিনি ভেবেছেন, সেজন্য তিনি স্বাক্ষরতার হার কমিয়ে দিলেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তারা পিছিয়ে দিয়েছে।”
“বিএনপি যখন ক্ষমতায় গেল তখন তাদের দোসর ছিল যুদ্ধাপরাধীরা। তারা ছিল খালেদা জিয়ার ক্যাবিনেটে মন্ত্রী। তারা কেন আমাদের দেশকে এগুতে দিবে? সন্ত্রাস, লুটপাট, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ ও অস্ত্র ছাড়া আর কিছুই তারা দিতে পারেনি। পাকিস্তানি বাহিনী যা করেছে তার দোসর ২০০১- ২০০৬ পর্যন্ত তা করেছে। আমরা দিয়েছি বিদ্যুৎ আর বিএনপি নেত্রী তখন দিয়েছেন খাম্বা। তার ছেলের খাম্বা কোম্পানি ছিল।”
“২০১৫ সালে খালেদা জিয়া আবার শুরু করলো তাণ্ডব। তার বাসা গুলশানে, অফিসও গুলশানে। তিনি বাসা ছেড়ে অফিসে এসে বসলেন। আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাত না করে ঘরে ফিরবে না। মানুষ খুন করে সরকার উৎখাত করবে। পেট্রোল দিয়ে অনেক মানুষ খুন করেছে। ২৩১ জনকে পেট্রোল বোমা দিয়ে খালেদা জিয়া হত্যা করেছিল। ৩ হাজার ৩৬ জন মানুষকে পেট্রোলবোমা মেরে নানাভাবে আহত করেছে। ২৩ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করেছে। মসজিদে আগুন দিয়েছে। শত শত কোরআন শরিফ পুড়িয়েছে। এটাই ছিল খালেদা জিয়ার আন্দোলন। এরপর যখন জনগণ তা প্রতিহত করতে শুরু করলো, তখন জনগণের হাতে ধাক্কা খেয়ে কোর্টে হাজিরা দিয়ে ঘরে ফিরে গেলেন।”
“যারা যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানায়, তাদের হাতে এদেশের গণতন্ত্র সুরক্ষার কথা মানায় না। সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদেরও তারা উস্কে দিচ্ছে। বরং বাংলার জনগণই এদের বিচার করবে।”
খালেদার সমালোচনা করে তিনি আরো বলেন, “এতিমের টাকা চুরি করে খেয়েছেন তিনি। মামলার হাজিরা দিতে যান। একদিন যান তো দশদিন যান না। কেন যান না? চোরের মন পুলিশ পুলিশ। তার কাছ থেকে রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ভাষা শিখতে হবে, এটা হয় না।”
“সবার কাছে আহ্বান জানাই, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ পথে যাতে কেউ না যায়, সেজন্য শিক্ষা দিতে হবে। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম কখনো মানুষ হত্যা শেখায় না। বিচার করার মালিক আল্লাহ। তিনি বিচার করবেন। আজ যারা ধর্মের নামে সন্ত্রাস করছে, আত্মঘাতি করছে- তারা কখনো বেহেস্তে যাবে না বরং তারা দোজখে যাবে। এদেশের মানুষ তার ধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে পালন করবে, ইসলাম সে শিক্ষাই দিয়েছে। সেভাবে প্রত্যেকে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।”
শেখ হাসিনা আরো বলেন, “জাতির পিতা আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশকে একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলবো। ২১ সালে সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন করবো। বাংলাদেশে দারিদ্রতার হার কমাবো, স্বাক্ষরতা বাড়াবো। প্রতিটি স্কুলেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম হবে। গ্রামকে শুধু গ্রাম হিসেবে না, প্রতিটি গ্রামই নগর হিসেবে গড়ে উঠবে। আমরা সে বাংলাদেশ গড়ে তুলবো।”
মঙ্গলবার দুপুর ১২টার পর থেকেই আসতে শুরু করে দলের নেতাকর্মীরা। ঢাকা মহানগরসহ দেশের জেলা-উপজেলা থেকে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী দলীয় ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে মিছিল করতে করতে উদ্যানে প্রবেশ করতে থাকেন।
এর আগে সমাবেশস্থলের পশ্চিম দিকে, ছবিরহাট গেট, টিএসসি গেট, কালীমন্দির গেট এবং তিন নেতার মাজার গেট দিয়ে সমাবেশে প্রবেশ করে জনসভায় অংশ নিতে আসা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ঢোল-করতাল নিয়ে বিভিন্ন স্লোগানে নেতা-কর্মীরা মুখরিত করে তোলে সমাবেশের আশপাশের এলাকা।
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন যান। সেখান থেকে নতুন দিল্লি হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন ১০ জানুয়ারি। তার প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নবযাত্রা শুরু করে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রযাত্রা দ্রুত শুরু হয়। জাতি একটি আধুনিক সংবিধান লাভ করে।