প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ৭১তম জন্মদিন আজ বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর)। ১৯৪৭ সালের এই দিনে তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে একটি হাসপাতালে গলব্লাডার অপারেশনের পর সেখানকার আবাসস্থলে বিশ্রামে রয়েছেন। সেখানেই তিনি ঘরোয়া পরিবেশে জন্মদিন কাটাবেন। গত কয়েক বছর জন্মদিনের সময়টাতে জাতিসংঘ অধিবেশনের যোগ দেওয়ার কারণে শেখ হাসিনা জন্মদিনে ঢাকায় থাকতে পারছেন না। তবে, তার অনুপস্থিতিতে দল ও সহযোগী সংগঠনগুলো অন্যান্য বছরের মতো এবারও মিলাদ ও দোয়া মাহফিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দলীয় সভাপতির জন্মদিন উদযাপন করবে। তবে, শেখ হাসিনার নির্দেশে এবার জন্মদিনে কোনও কেক কাটা বা উৎসব পালন হচ্ছে না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচার, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের কাণ্ডারিসহ জাতীয় জীবনের বহুক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন তিনি।
শেখ হাসিনা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রথম সন্তান। তার ডাক নাম হাসু। পিতা বঙ্গবন্ধু আদর করে এই নামেই ডাকতেন তাকে। শেখ হাসিনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে দাদা-দাদির কোলে-পিঠে মধুমতি নদীর তীরে টুঙ্গিপাড়ায়। তারা পাঁচ ভাই-বোন। অপর চার জন হলেন— শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল। ভাই-বোনদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও রেহানা ছাড়া কেউই জীবিত নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে পিতা বঙ্গবন্ধু এবং মাতা ফজিলাতুন্নেছাসহ সবাই ঘাতকদের হাতে নিহত হন।
শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবন শুরু হয় টুঙ্গিপাড়ার এক পাঠশালায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখন তারা পুরনো ঢাকার রজনী বোস লেনে ভাড়া বাসায় ওঠেন।
বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য হলে সপরিবারে ৩ নম্বর মিন্টু রোডের বাসায় তারা বসবাস শুরু করেন। শেখ হাসিনাকে ঢাকা শহরে টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে ভর্তি করা হয়। তিনি ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। ওই বছরেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হন এবং ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
শেখ হাসিনা ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে পড়ার সময় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদস্য এবং রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
পিতা বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে থাকাকালে ১৯৬৮ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী ড.ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যাওয়ার পর গোটা পরিবারকে ঢাকায় ভিন্ন এক বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই শেখ হাসিনা গৃহবন্দী অবস্থায় তার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম দেন। ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর কন্যা সন্তান পুতুলের জন্ম হয়।
১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগে ছোট বোন শেখ রেহানাসহ শেখ হাসিনা ইউরোপ যান। সেখানে অবস্থানকালে তিনি সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নিহত হবার খবর পান। তাৎক্ষণিকভাবে দেশে ফেরার কোনও পরিবেশ না থাকায় তিনি ইউরোপ ছেড়ে স্বামী-সন্তানসহ ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন।
১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আর ওই বছরেরই ১৭ মে দীর্ঘ ছয় বছর প্রবাস জীবনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি তিনটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালের ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের পরে তিনি পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে এবং সে বছরের ২৩ জুন দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি সপ্তম জাতীয় সংসদে বিরোধীদলের নেতা নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন নিয়ে বিশাল বিজয় অর্জন করে। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তৃতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
জন্মদিনের কর্মসূচি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭১তম জন্মদিন উপলক্ষে ২৮ সেপ্টম্বর দেশের সরকারি হাসপাতালসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ২ ঘণ্টা বেশি স্বাস্থসেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। চিকিৎসকেরা এদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টার পরিবর্তে ৪টা পর্যন্ত মানুষকে সেবা দেবেন। জন্মদিন উপলক্ষে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ দেশের বিভিন্ন মসজিদে মিলাদ মাহফিল ও বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকেশ্বরী মন্দির, প্যাগোডা, গির্জাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উপসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিকালে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিকাল ৩টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে মিলাদ, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সভাপতি শেখ হাসিনার ৭১তম জন্মদিন পালন করার জন্য দলের জেলা, উপজেলাসহ সব শাখা এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সব স্তরের নেতাকর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে তার জন্মদিনে কোনও ধরনের কেক কাটা ও আনন্দ উৎসব থেকে বিরত থাকার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
এর আগে, গত ৮ জুলাই অনুষ্ঠিত দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা তার জন্মদিন দলীয়ভাবে পালন করবেন না বলে জানান। ওই দিন দলের পক্ষ থেকে জন্মদিনের কর্মসূচি নেওয়ার প্রস্তাব উঠলে শেখ হাসিনা তার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘আমার জন্মদিন আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিভাবে কেন পালন করবে? আমি এটা চাই না। আগেও আমি এ বিষয়টি নিষেধ করেছি। তারপরও কেন এটি আলোচ্যসূচিতে রাখা হলো?’ পরে ওই বৈঠকে শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে কোনও কর্মসূচি গৃহীত হয়নি।