সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে নারীরা কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। কত যে বিচিত্র পন্থায় নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটছে! ঘরে-বাইরে, শিক্ষাঙ্গনে-কর্মস্থলে—সর্বত্র মেয়েদের নানা ধরনের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। একশ্রেণির বখাটে যুবক নারীর প্রতি অন্যায় ও অশোভন আচরণ করে থাকে। ফলে নারী নির্যাতনের ঘটনা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ধর্ষণের শিকার নারীদের কেউ কেউ আত্মহত্যায় বাধ্য হন। কখনো পাষণ্ড স্বামী নিজের স্ত্রীকেও মারধর করছেন! এমনকি নির্যাতনকারী পুরুষ নারীকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করছেন না। এসবের মূলে মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য ও আন্তরিক প্রেম-ভালোবাসার অভাব এবং নারীর সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টিলোলুপ কামনা-বাসনা বখাটেদের অন্তরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে।
অথচ অর্থের লোভে বিদেশে নারী পাচার করে, স্বামী-স্ত্রীর বিরোধের জের হিসেবে বা যৌতুকের জন্য মারধর বা শ্বাসরোধ করা, বিষ প্রয়োগ, গণধর্ষণের পর হত্যা, গুলি ও অ্যাসিড নিক্ষেপ করে নানা উপায়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন চলছে। এসব লোমহর্ষক নির্যাতন বন্ধের উপায় খুঁজে বের করে সমস্যার সমাধানকল্পে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালানো খুবই জরুরি।
অ্যাসিড মেরে নারীর প্রতি প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণ, যৌতুকের জন্য নিরীহ বধূর ওপর শ্বশুরালয়ের সবাই মিলে মানসিক নির্যাতন চালানো, কখনো শারীরিক অত্যাচার এমনকি গুপ্তহত্যার ঘটনাও ঘটে থাকে! নারী নির্যাতন বন্ধে সচেতন অভিভাবক মহলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা দরকার। সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে যে নারী-পুরুষ মিলে যে ঘরসংসার, বহু ঘর নিয়ে যে মুসলিম সমাজ, সেখানে প্রত্যেকেরই গুরুত্ব, মর্যাদা, অধিকার ও ভূমিকা রয়েছে।
বৈবাহিক রীতি অনুযায়ী নারী ও পুরুষ পরস্পরকে পছন্দ করে যে নীড় বাঁধেন, সেই সুখের ঘরে একে অন্যের প্রতি কোনোক্রমেই শত্রুভাবাপন্ন ও নির্যাতনকারী হতে পারেন না। পারিবারিক জীবনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসাই ঘরের বন্ধনটি সুদৃঢ় ও শান্তিময় করে রাখতে পারে। ইসলামে নারীদের অনেক বেশি মর্যাদা ও অধিকার দেওয়া হয়েছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণীকে কাজে লাগাতে হবে। নারী-পুরুষের সুন্দর শান্তিময় জীবন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে, যেমন আছে তাদের ওপর পুরুষদের।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৮)
গত বছর (২০১৬) নারী নির্যাতনের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি এর মাত্রা ও ধরনে ছিল ভয়াবহতা। ২০১৬ সালে নারী উত্ত্যক্ত, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, হত্যা ও সালিসের মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা আগের বছরের চেয়ে বেশি ছিল। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৬ ও আসকের পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় শিশু নির্যাতনের মাত্রা ও ধরনে ভয়াবহতাও অব্যাহত ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ থাকার পরও কমছে না নারী নির্যাতন। নির্যাতনের অনেক ঘটনায় মামলা হলেও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে আপস-মীমাংসা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হয় ৭২৪ জন নারী । এর মধ্যে ধর্ষণের পরে ৩৭ জনকে হত্যা করা হয় ও ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেন ৮ জন। সালিস ও ফতোয়ার মাধ্যমে মোট ১২ জন নারী নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে গ্রামছাড়া, সমাজচ্যুত বা একঘরে করা, মাথার চুল কেটে দেওয়াসহ শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে মাত্র তিনটি। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ২৩৯ জন নারী, মামলা হয়েছে ৯৫টি। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৩৯৪ জন, যার মধ্যে থানায় মামলা হয়েছে ১৮৭টি। নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় মোট ৬৪ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ৩২টি ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে বছরটিতে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা কম ছিল, অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হন ৩৪ নারী, এ ঘটনায় একজন মারা যান। এর মধ্যে মাত্র ১২টি ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মস্থলে যৌন নির্যাতন ও বখাটের উত্ত্যক্তকরণের শিকার হন ২৪৪ জন। এর মধ্যে ৬ জন নারী আত্মহত্যা করেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় খুন হন ৭ জন নারী ও ৭ জন পুরুষ। বখাটেদের প্রতিবাদ করায় লাঞ্ছিত হয়েছেন ১৩৮ জন। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে পাঁচ ছাত্রীর।
প্রতিবেদনে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের খসড়া সম্পর্কে বলা হয়েছে, দেশের নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নিন্দা ও প্রতিবাদের মুখেও ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’ -এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর থাকলেও বিশেষ ক্ষেত্রে ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবার সম্মতিতে ১৮ বছরের নিচে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ের বিধান রাখা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বছরটিতে হত্যার শিকার হয় মোট ৪১৫ শিশু। আত্মহত্যা করে ২২ শিশু ও রহস্যজনক মৃত্যু হয় ২৮ শিশুর। এসব ঘটনায় মোট ১৭৬টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, উত্ত্যক্ত করণসহ মোট এক হাজার ৩৪টি ঘটনা ঘটে ও মামলা হয় ২৬০ টি।
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। সমাজে নারী ও পুরুষের যে ন্যায্য অধিকার ও গুরুত্ব রয়েছে, উভয়ে মিলে তাঁরা যে অভিন্ন সত্তা, এ মানবিকতাবোধকে পুরুষেরা গভীরভাবে উপলব্ধি না করলে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে না। কারণ, নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই নির্যাতনের মূল সূত্রটি লুক্কায়িত আছে। এ মনোভাব পাল্টানোর জন্য উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের পাশাপাশি দেশের সমাজ ও সচেতন নাগরিকদের প্রধান দায়িত্ব নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করার লক্ষ্যে সমাজে মূল্যবোধ, সুনীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার সামাজিক আন্দোলন জোরদার করা। নারীর প্রতি পুরুষের যখন পরিপূর্ণ আস্থা আসবে এবং স্ত্রীকে প্রেম–প্রীতি ও মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করা যাবে, তখনই পৃথিবী শান্তির নীড় হবে।
সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ও বিজাতীয় অপসংস্কৃতির প্রভাব, সুস্থ বিনোদনের অভাব কিংবা অন্যান্য কারণে সমাজে বখাটে যুবকদের সংখ্যা বাড়ছে, তা সমাজের অভিভাবকদের যেমন খুঁজে বের করতে হবে, তেমনি নারী নির্যাতন গণপ্রতিরোধের আন্দোলনেও শামিল হতে হবে। দেশে নারী নির্যাতনবিরোধী কঠোর আইন রয়েছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগের অভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না। তাই নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমাজকে সচেতনতা সৃষ্টির গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। সেই সঙ্গে মা-বোনদেরও নিজ নিজ মানবিক মর্যাদা, শালীনতা রক্ষা এবং অধিকার-কর্তব্যের প্রতি সজাগ থাকা উচিত। পুরুষ নারীর প্রতিপক্ষ নন, নারী পুরুষের প্রতিপক্ষ নন; বরং দুয়ে মিলেই সমাজ। এ সচেতন দৃষ্টিভঙ্গির লালন ও নীতি-নৈতিকতার বিকাশের মধ্যেই নিহিত আছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের বীজমন্ত্র।
আসুন সবাই মিলে নারী নির্যাতন বন্ধ করে জাতিকে কল্কংকের হাত থেকে মুক্তি দেই ও একটি সুন্দর সোনার দেশ ও জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে নিজেদের সম্মান ফুটিয়ে তুলি।
আজ থেকে তাই আমাদের এই প্রতিজ্ঞা হোক “নারী নির্যাতন কে না” ।
প্রতিবেদন- আকবর রাব্বী