মেয়েটি লালমাটিয়া মহিলা কলেজের ছাত্রী। প্রায় একই রকম হয়রানির ঘটনা। মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার হোপের গলিতে দারুণ সব ওড়না বিক্রি হয়। মেয়েটি গিয়েছিল কিনতে। দামে পোষায়নি, রঙটাও হালকা। চলে যাচ্ছিল, পেছন থেকে হঠাৎ ডাকল দোকানি। বলল 'কই যান আপা, যে রং চান ভরে দেব, আসেন।'
কথাটা খুব কানে বাজল মেয়েটির। ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটি বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ফিরেই যাবে ভেবেছিল কিন্তু ফিরতে পারল কই? পরের কথাটি এতোই আপত্তিকর যে, মেয়েটিকে দাঁড়াতেই হলো।
চলে যেতে উদ্যত হলে দোকানি পেছন থেকে বলেছে, 'দরকার হলে মুলো ভরে দেব, তাও আসেন আপা।'
অশোভন এই কথায় আর চুপ থাকতে পারল না। প্রতিবাদ করল মেয়েটি। জানতে চাইল, এসব কথার মানে কি? মধ্যবয়সী লোকটি তখন হাসল। আরো ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ করতে থাকল। লজ্জায়, অপমানে থর থর করে কাঁপতে থাকল মেয়েটি। চোখে পানি চলে এলো। চারপাশে এতো মানুষ, তবু কোথাও যেন কেউ নেই!
এসব মার্কেট এলাকায় যা হয় আরকি, অসহায় নারীকে পেয়ে একজোট হয়ে যায় কর্মচারিরা। চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরে মেয়েটিকে।
মেয়ে মানুষ চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে যাবে, প্রতিবাদ কেন করল- এই নিয়ে তর্ক বেঁধে যায়। চোখ মুছতে মুছতে সংক্ষুব্ধ মেয়েটি দোকানিকে বলল, 'আপনি যে কথা বলেছেন তাতে আপনাকে জুতা দিয়ে পিটানো উচিত।'
আর যায় কোথায় দোকানি নিজের জুতা খুলে মেয়েটির দিকে তেড়ে আসে, 'খা×কি মা×, তোরে খাইছি...!' শেষ রক্ষা হয় কয়েকজন বয়স্ক লোক এগিয়ে আসায়। মেয়েটি আশান্বিত এই ভেবে যে, এবার বুঝি এই অন্যায়ের প্রতিকার পাবে।
কোথায় কি? আশপাশের লোকেরা জুতাপেটা থেকে বাঁচালো ঠিকই কিন্তু রাজ্যের ভর্ৎসনা করে মেয়েটিকে তাড়িয়ে দিল, যেভাবে তারা প্রতিদিন ভিখারি তাড়ায়!
লজ্জায়, অপমানে কুন্ঠিত মেয়েটি বাসায় ফিরে রাতভর কেঁদেছে। তারপর ঠিক করেছে প্রতিবাদ করার। একটা উচিত শিক্ষা সে লোকটাকে দিতে চেয়েছে। ক'দিন আগে ইডেন ছাত্রীদের সঙ্গে চাঁদনি চকের দোকানিদের অশোভন আচরণ এবং তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার ঘটনাটি মেয়েটিকে অনুপ্রাণিত করেছে।
তারপর রচিত হলো প্রতিবাদের আরো এক চমৎকার গল্প। তৈরি হলো সাহসীকতার উদাহরণও।
মেয়েটি আমার সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করলে আমি বিষয়টি জানাই নিউমার্কেট জোনের সহকারি পুলিশ কমিশনার সাজ্জাদ রায়হান ভাইকে। সম্প্রতি ইডেনের ঘটনায় অনন্য সহায়তা করেছিলেন তিনি। জানালেন, মিরপুরের এসি সৈয়দ মামুন মোস্তফা তার খুব কাছের মানুষ। ফোনে তাকে অনুরোধ করলেন মেয়েটিকে সহায়তার।
মেয়েটিও ততোক্ষণে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে একটি দরখাস্ত লিখে তৈরি। রাত নয়টার দিকে গেলাম মিরপুর মডেল থানায়। সব শুনে এসি মামুন ভাই এবং ওসি নজরুল ভাই একটি টিম পাঠিয়ে মতিন মুন্সি নামের ওই দোকানিকে ধরে নিয়ে এলেন।
তারপর থানায় একটি চেনা দৃশ্যের অবতারণা। দোকানি নিজের ভুল স্বীকার করে মেয়েটির পা ধরে মাফ চাইতে লাগল। অন্য দোকানিরাও অনুরোধের বন্যা বইয়ে দিল। কিন্তু উদাহরণ তৈরি করতে বদ্ধ পরিকর মেয়েটি আইনী প্রক্রিয়াতেই লোকটির শাস্তি চাইল।
তার একটাই বক্তব্য, আজকে একে ছেড়ে দিলে সবার ধারণা হবে অপরাধ করলে পার পাওয়া যায়! ফলে একে কোনোভাবেই ক্ষমা করা যাবে না।
ব্যাস, রাতেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছে মিরপুর থানায়। আসামীকে চালান করা হয়েছে কোর্টে। দু-চার মাসের আগে জামিনের সম্ভাবনা নেই।
মিরপুরের মার্কেটগুলোতে হাজার হাজার নারী নিত্য কেনাকাটা করতে যান। দোকানের বদমায়েশ কিছু কর্মচারির দ্বারা প্রতিনিয়তই এসব নারীরা নানা ভাবে নিগৃহীত হন, হয়রানির শিকার হন। মুখ বুজে সহ্য করায় দিনে দিনে ব্যাপারটিকে তারা নিয়মে পরিণত করে ফেলেছেন।
এসব ঘটনায় দু-একজন যদিও বা প্রতিবাদ করে, সদলবলে ওরা তখোন হামলে পড়ে। প্রায়শই সেইসব দু:খের কাহিনী ফেসবুকে শেয়ার করেন ভূক্তভোগি নারীরা। কিন্তু প্রতিবাদের সঠিক রাস্তাটা জানা না থাকায় অনেকেই ইচ্ছা থাকা সত্যেও প্রতিকার পাননা। প্রতিবাদী নারীদের জন্য আজকের ঘটনাটা আলোকজ্জ্বল একটা উদাহরণ হতে পারে।
একটু সাহস নিয়ে এগিয়ে এলে, নিয়ম মেনে প্রতিবাদ করলে এবং সেই প্রতিবাদটা সঠিক যায়গায় পৌঁছে দিতে পারলে- এই দেশেও যে অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া সম্ভব, এসব ঘটনায় তা কিন্তু বারবার প্রমাণিত হচ্ছে।
নেই নেই করেও আমাদের দেশে যতটুকু নাগরিক সুযোগ-সুবিধা আছে, আইন আছে আমরা তার কতটুকু ব্যবহার করতে পারছি?
সহকারী কমিশনার সাজ্জাদ রায়হান, সৈয়দ মামুন মোস্তফা, ওসি নজরুল ভাইকে ধন্যবাদ দিলে কম হবে। শুধু এটুকু বলব, আপনাদের মতো অফিসার আছে বলেই এখনও সব নষ্টদের অধিকারে যায়নি।
মার্কেট এলাকায় প্রতিনিয়ত অনিয়ম-দূর্ভোগের শিকার নারীদের মধ্যে যারা ফেসবুকে চিল্লাপাল্লা না করে সত্যি সত্যিই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চান, তারা আমাদের এই নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের পথটা অনুসরণ করতে পারেন। অবশ্যই প্রতিকার পাবেন। কেননা আমরা প্রতিনিয়ত নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের উদাহরণ তৈরি করে যাচ্ছি।
আর হ্যা, মনে রাখবেন, আপনার প্রতিবাদটি অন্য কেউ এসে করে দিয়ে যাবে না। শুরুটা অন্তত আপনাকেই করতে হবে। এই দেশে কিছু হয় না বলে যারা পাশ কাটিয়ে যান, যারা প্রতিবাদের বদলে প্রতিনিয়ত অন্যায়কে মেনে নেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, নিজের যায়গা থেকে একটুখানি আওয়াজ তুলুন। জনারণ্যে শুরুতে সেই আওয়াজ বড় ক্ষীণ আর বেমানান ঠেকলেও ধীরে ধীরে দেখবেন আরো সহস্র আওয়াজ আপনার দিকে ছুটে আসছে। গণমানুষের সম্মিলিত সেই আওয়াজের সামনে দাঁড়ায়, এমন অপশক্তি কোথায়?
সূত্র: কালের কণ্ঠ।