রাজধানীর মিরপুরের দারুস সালামের বর্ধনবাড়ির ‘কমল প্রভা’ জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া গোলাবারুদ দিয়ে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সিরিজ বোমা হামলার পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গি আবু আবদুল্লাহ। এজন্য সে শক্তিশালী বোমা তৈরির সরঞ্জাম মজুদ করে রেখেছিল ওই বাড়িটিতে। গতকাল র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। র্যাব সূত্র জানায়, ‘কমল প্রভা’ বাড়িটিতে বিস্ফোরিত ও উদ্ধার করা গোলাবারুদ দিয়ে অন্তত ১০টি স্থানে বহুতল ভবন উড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা ছিল। সূত্র জানান, জঙ্গি আবদুল্লাহ এসব হামলার জন্য নকশাও তৈরি করে। বাসাটি ছিল বোমা তৈরির কারখানা। ওই বাসায় জঙ্গি আবদুল্লাহর সঙ্গে আরও ৫ থেকে ৬ জনের যাতায়াত ছিল। বাড়িটিতে অনেক জঙ্গি প্রশিক্ষণও নিয়েছে। বিস্ফোরণে দুজন সহযোগী মারা গেছে। বাকিদের বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যেহেতু লাশগুলো একেবারেই পুড়ে গেছে সে জন্য তাদের ডিএনএ টেস্ট করে শনাক্ত করতে হবে। এ ছাড়া ছয়তলা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে। গত বৃহস্পতিবার রাতের বিরতির পর গতকাল সকাল পৌনে ৯টার দিকে ফের অভিযান শুরু করে র্যাব। অন্যদিকে ‘কমল প্রভা’ ভবনের জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষ করেছে র্যাব। টানা ৮৮ ঘণ্টা জুড়ে অভিযান গতকাল বিকেল ৪টায় আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এর আগে গত সোমবার রাত ১২টা থেকে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরু করে র্যাব।
গতকাল অভিযান শেষে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান। তিনি বলেন, জঙ্গি আস্তানা থেকে ১৭টি শক্তিশালী বোমা, ৩০টি ইম্প্রোভাইজ হ্যান্ড গ্রেনেড, কেমিক্যাল বোমা ৫০টি, এক কন্টেইনার অ্যাসিড, ১০ কেজি গান পাউডার, ৩ কেজি সালফার, ১১টি কন্টেইনারে দাহ্য পদার্থ, স্পিন্টার ১৫ কেজি, ৬১টি ধারালো অস্ত্রসহ চারকোল, ইগনাইটিং কর্ড, সার্কিট ও মাস্ক উদ্ধার করা হয়েছে। ভবনটি এখন বিস্ফোরকমুক্ত। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম তলা র্যাবের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ভবনটি বসবাসের উপযোগী কি না জানতে চাইলে র্যাবের এই মুখপাত্র বলেন, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার পর তা জানানো যাবে। বাসিন্দাদের অপেক্ষা করতে হবে। বিস্ফোরণে দুটি ফ্লোর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে সেটা টেকনিক্যালি পরীক্ষা ছাড়া বসবাসের জন্য কতটুকু নিরাপদ তা বলা যাচ্ছে না। জঙ্গি আবদুল্লাহর লাশ নিতে তার পরিবার অস্বীকার করেছে। বাকি দুই সহযোগীর পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। র্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং বোমা ডিস্পোজাল ইউনিটের সদস্যরা ভবনে প্রবেশ করে তল্লাশি শুরু করেন। ভবনের একটি ফ্ল্যাটে তল্লাশি অভিযান বাকি ছিল, গতকাল সেখানে অভিযান চালিয়ে প্রচুর ক্যাচিং ও কার্টন পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বোমা তৈরির প্রচুর বিস্ফোরক ও সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয় বলে জানান র্যাব মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গার একটি বাড়ি থেকে গত সোমবার রাতে জঙ্গি সন্দেহে দুই ভাইকে গ্রেফতার করে র্যাব। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ‘ফলোআপ’ হিসেবে বর্ধনবাড়ি এলাকার ২/৩-বি ‘কমল প্রভা’ ভবন ঘেরাও করে র্যাব। বাড়িটির মালিক সাবেক টিঅ্যান্ডটির কর্মকর্তা হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ। গত মঙ্গলবার দিনভর আবদুল্লাহকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। দুপুরে ‘জঙ্গি’ আবদুল্লাহর বোন মেহেরুন্নেসা মেরিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব। এ সময় ওই বাড়ির ২৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৩টি ফ্ল্যাট থেকে ৬৫ বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় ‘জঙ্গি’ আবদুল্লাহ আত্মসমর্পণে রাজি হন। আত্মসমর্পণের কথা বলে রাত পৌনে ১০টার দিকে বাড়িটিতে পরপর চারটি বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বাড়ি থেকে আগুন ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হয়। বিস্ফোরণের পর র্যাবের কর্মকর্তারা বলেন, ‘ বাড়ির ভেতরে থাকা জঙ্গিরা নিজেরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। এতে ৫ র্যাব সদস্য আহত হন। আবদুল্লাহ জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপের আল-আনসার সদস্য ছিল। গত বুধবার ভবনের ভেতর থেকে সাতজনের পোড়া লাশ পাওয়া যায়। নিহতদের মধ্যে জঙ্গি আবদুল্লাহ, তার দুই স্ত্রী নাসরিন ও ফাতেমা, দুই ছেলে ওমর ও ওসামা এবং বাকি দুজন আবদুল্লাহর কর্মচারী বলে জানান র্যাব কর্মকর্তারা। দুই কর্মচারীর মধ্যে একজন কামাল হোসেন বলে দাবি করে তার বাবা-মা। জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ভবনটির মালিক আজাদ ও নৈশপ্রহরী সিরাজুল ইসলামকে সাভারের একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়েছে র্যাব। র্যাব বলছে, গতকাল সকাল ৯টা থেকে ‘কমল প্রভা’ জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরু করা হয়। গত বৃহস্পতিবার ষষ্ঠ তলার একটি অংশে তল্লাশি সম্পন্ন হয়েছিল। গতকাল সেখানে আরেকটি অংশে, যেখানে ফ্রিজ রয়েছে সেগুলো সাবধানতার সঙ্গে খোলা হয়। দুটি ফ্রিজের সঙ্গে ইম্প্রোভাইজড বোমার সংযোগ ছিল। সেখান থেকে আরও কিছু বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। ছয়তলা ওই ভবনের প্রতিটি তলায় রয়েছে চারটি করে ইউনিট। এর মধ্যে পঞ্চম তলার দুটি ইউনিটে সন্দেহভাজন জঙ্গি আবদুল্লাহ পরিবার নিয়ে থাকত। ষষ্ঠ তলার অর্ধেক অংশে সে কবুতর পুষত। বাকি খোলা জায়গায়ও কবুতর রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো। আবদুল্লাহ ২০০৫ সাল থেকে জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার বাসায় সারোয়ার, তামিম ও মাহফুজসহ জঙ্গি নেতাদের যাতায়াত ছিল।