অবসরের পরও বাসা, গাড়ি, গৃহকর্মী, নিরাপত্তা কর্মী ও টেলিফোন সুবিধা চেয়েছেন সচিবরা। একই সঙ্গে গাড়িতে প্রতীক এবং সিনিয়র সচিবের পদ বাড়ানো ও অবসরের বয়সসীমা ৬২ বছর করার সুপারিশ করেছেন সরকারের শীর্ষ এই কর্মকর্তারা। এছাড়া আদালত অবমাননা থেকে পরিত্রাণ এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মোবাইল কোর্ট পরিচালনা নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের বিষয়েও সমাধানসহ বিচার ব্যবস্থার সমস্যার সমাধান চেয়েছেন সচিবরা। গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে সচিবরা এসব দাবি জানান। ৩৮ মাস পর সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে বসে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই সরকারের অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রমকে শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে দুই ডজনের বেশি বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত সচিব সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীসহ ৭১ জন সচিব উপস্থিত ছিলেন। তার মধ্যে ১৬ জন সচিব বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। সচিব সভায় উপস্থিত একাধিক সচিব সকালের খবরকে জানান, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সিরাজুল হক খান চারটি বিষয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন। তার মধ্যে অবসরের পর প্রিভিলেজ সুবিধা, গাড়িতে প্রতীক এবং সরকারি চাকরিজীবীদের বয়স ৬২ বছর করার বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী শুনেছেন, কোনো মন্তব্য করেননি। তবে বিচারব্যবস্থার সমস্যার বিষয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি, আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। এছাড়া আরেকজন সচিব সিনিয়র সচিবের পদ বাড়ানোর কথা বলেছেন। একাধিক সচিব জানান, একজন বিচারপতি অবসরে গেলেও তার মর্যাদাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা বহাল থাকে। কিন্তু একজন সচিব চাকরি শেষে এক বছর অবসরত্তোর ছুটি ভোগ করার পর আর কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। তাই অবসরে যাওয়ার পর পেনশন ভোগ করা পর্যন্ত পিআরএলের সময় পাওয়া সুবিধাগুলো বহাল রাখার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেছেন তারা। এছাড়া সিনিয়র সচিব/সচিবদের সমপর্যায়ের অনেকে গাড়িতে পরিচিতি চিহ্নিত করতে বিশেষ পতাকা বা প্রতীক ব্যবহার করছেন। কিন্তু সচিবদের গাড়ি চেনার ক্ষেত্রে কোনো পতাকা বা প্রতীক নেই। এতে করে বিভিন্ন স্থানে সচিবদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তাই তারা মনে করেন, সচিবদের গাড়িতে বিশেষ কোনো চিহ্নিত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল সচিবদের সঙ্গে বর্তমান মেয়াদের প্রথম বৈঠক করেছিলেন। এত দিন পর প্রধানমন্ত্রীর আবার এবারের সচিব সভায় যোগ দেওয়া এটি বিশেষ গুরুত্ব ছিল। বর্তমান সচিবদের প্রায় অর্ধেক এর আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো সচিব সভা করেননি। ২০১৪ সালের সচিব সভার পর নতুন সচিব যারা হয়েছেন তাদের স্বাগত জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে এই সরকারের মেয়াদে এটাই সচিবদের সঙ্গে শেষ বৈঠক বলেও জানিয়েছেন সরকারপ্রধান। প্রধানমন্ত্রী সচিবদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় দুই ডজন নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমদানি-রফতানির কাজ সহজ করতে দেশের সব নৌ ও স্থলবন্দর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখতে হবে। জেলায় জেলায় ত্রাণ তত্পরতা বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রতি জেলায় চাহিদা অনুযায়ী ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহে রাখতে হবে। স্থানীয়ভাবে প্রকল্প নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে তিনি যত্রতত্র শিল্প-কারখানা না করে সরকার কর্তৃক শিল্পাঞ্চলে করতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেছেন, অর্থবছরের শেষদিকে তাড়াহুড়ো না করে বছরের শুরু থেকেই বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করুন। বর্ষা মৌসুমে প্রকল্পের পেপারওয়ার্ক সম্পন্ন করুন। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের প্রয়োজন হলে তা দ্রুত করে ফেলুন। পাশাপাশি কাজের গুণগতমানের সঙ্গে কোনো আপস করা যাবে না। কিন্তু কোনো বছরই শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন হয় না এবং অর্থবছরের শেষ দিকে তড়িঘড়ি অর্থ খরচ করা হয়। বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৬৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করা গেছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪ শতাংশ পয়েন্ট বেশি। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে গ্রাম উন্নয়ন, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমানো, দুর্নীতি রোধ, সুশাসন নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে তা বাস্তবায়নে শীর্ষ আমলাদের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, গ্রাম উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে, কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। যাতে গ্রামের মানুষ কাজের খোঁজে শহরে না আসে। শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ যাতে না বাড়ে সে ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী দক্ষ এবং যোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে ভালো কাজের জন্য পুরস্কার আর মন্দ কাজের জন্য তিরস্কারের ব্যবস্থা করতেও নির্দেশ দেন তিনি। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যে হারে বেতন-ভাতা বাড়িয়েছি পৃথিবীর কোনো দেশ তা করতে পারেনি। দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এটা কোনোভাবেই যেন না হয়। প্রধানমন্ত্রী জঙ্গিবাদ দমন ও মাদক নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ এবং এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। এছাড়া আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করে ন্যায়সঙ্গত পদোন্নতি এবং পদায়ন নিশ্চিত করা এবং তরুণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে অগ্রাধিকার দিতেও পরামর্শ দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী সচিবদের উদ্দেশে বলেন, একটি রাজনৈতিক সরকার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্ষমতায় আসে। কিন্তু সচিবদের অনেক সময় ধরে সেবা দেওয়ার সুযোগ থাকে। সচিবদের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, তার দলের রাজনৈতিক দর্শন এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি একটি ভালো দল পেয়েছেন।