বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। তবে এতদিন ইলিশ যে বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য, তার স্বীকৃতি ছিল না। জামদানির পর এবার বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর ফলে ইলিশ বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পাবে।
বাংলাদেশের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর থেকে এবার ইলিশ নিজস্ব পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কর্তৃক ইলিশের স্বত্ব দাবি করার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু এবার আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশের ইলিশ মাছের স্বীকৃতির দাবি জোরাল হবে।
অধিদপ্তর বলেছে, ভৌগোলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন) পণ্য হিসেবে ইলিশ নিবন্ধনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে মৎস্য অধিদপ্তরের হাতে ইলিশের জিআই নিবন্ধনের সনদ তুলে দেওয়া হবে।
ইলিশের পেটেন্ট সনদ প্রদানকারী সংস্থা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর। এই অধিদপ্তরের কাজ হলো মেধাসম্পদ সুরক্ষায় নতুন নতুন উদ্ভাবনের পেটেন্ট, ডিজাইন স্বত্ব মঞ্জুর করা, পণ্য ও সেবার ট্রেডমার্ক ও ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নিবন্ধন করা।
এর আগে মৎস্য অধিদপ্তর ইলিশকে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। আবেদনটি পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর এ বছরের ১ জুন গেজেট প্রকাশ করা হয়। গেজেট প্রকাশ হওয়ার দুই মাসের মধ্যে দেশে বা বিদেশ থেকে এ বিষয়ে আপত্তি জানানোর সুযোগ থাকে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তরফে এ বিষয়ে কোনো আপত্তি না আসায় এ পণ্য এখন বাংলাদেশের স্বত্ব হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
বর্তমানে ইলিশের নিবন্ধন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে এক সপ্তাহের মধ্যে তার সনদ মৎস্য অধিদপ্তরকে দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম। বাংলাদেশে বিশ্বের মোট ৭৫ শতাংশ ইলিশ আহরিত হয়। এছাড়া ১৫ শতাংশ মিয়ানমার, ৫ শতাংশ ভারত ও ৫ শতাংশ অন্যান্য দেশের।
রূপালি ইলিশের বৈশিষ্ট্য নিয়ে পোনা থেকে বড় আকৃতির সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয় মৎস্য অধিদপ্তরের আবেদনে।
মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, দেশের পদ্মা-মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদী ও উপকূলীয় এলাকায় পাওয়া যায় ইলিশ। এটি লম্বায় সর্বোচ্চ ৬৩ সেন্টিমিটার ও ওজনে তিন কেজি ৩০০ গ্রাম হতে পারে। তবে সচরাচর ২ কোজি ওজনে পৌঁছানোর আগে জেলেদের জালে ধরা পড়ে ইলিশ।
একসময় দেশে প্রচুর পাওয়া গেলেও বর্তমানে দেশের প্রায় ১০০ নদ-নদীতে পাওয়া যাচ্ছে ইলিশ। এর প্রধান আহরণ এলাকা হচ্ছে- মেঘনা নদীর নিম্নাঞ্চল, তেঁতুলিয়া, কালাবদর বা আড়িয়াল খাঁ, ধর্মগঞ্জ, নয়াভাঙগানি, বিষখালি, পায়রা, রূপসা, শিবসা, পশুর, কচা, লতা, লোহাদিয়া, আন্ধারমানিকসহ অনেক মোহনা ও উপকূলীয় অঞ্চল।
সারা বছর ইলিশ ধরা পড়ে। নাব্যতা হ্রাস, পরিবেশ বিপযয়, জাটকা নিধন ও ডিমওয়ালা ইলিশ বেশি মাত্রায় আহরণে গত কয়েক দশকে ইলিশের উৎপাদন কমে গিয়েছিল। ইলিশ সংরক্ষণে নিম্ন পদ্মায় ইলিশের অভয়াশ্রম করায় আগের চেয়ে পরিমাণ বেড়েছে।
ইলিশ মাছ সারা বছরই প্রজনন করলেও বেশি করে অক্টোবর মাসের বড় পূর্ণিমায়। এসময় ৬০-৭০ শতাংশ ইলিশ পরিপক্ক ও ডিম ছাড়ার উপযোগী হয়। সাধারণ এক বছরের বয়সে মাছ পরিপক্ক হয়। আবহাওয়ার তারতম্যে অনেক সময় ৮-১০ মাস বয়সেও পরিপক্ক হতে পারে।
ঐতিহ্যে ইলিশ
জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের আবেদনে মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, ১৮২২ সাল থেকে ইলিশ বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও আমিষ জাতীয় খাদ্যে এ মাছের ভূমিকা রয়েছে।
বঙ্গোপসাগর থেকে জেলেদের জালে ধরা পড়া ইলিশ। ছবিটি চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজার এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার তোলা। ছবি: সুমন বাবু
জাতীয় মাছ ইলিশ দেশের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। প্রাচীন বাংলা, সংস্কৃত সাহিত্য ও লোকজ সংস্কৃতিতে ইলিশের স্বাদ, খাওয়ার পদ্ধতি এবং সংরক্ষণের বিষয়ে দিকনির্দেশনা রয়েছে।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ইলশে গুড়ি’ কবিতা এখনও আমাদের আলোড়িত করে। প্রাচীনকালের লোকজনের বিশ্বাস ছিল, আশ্বিন-কার্তিক মাসের দুর্গাপূজার দশম দিন থেকে মাঘ-ফাল্গুনের স্বরস্বতী পূজার দিন পর্যন্ত ইলিশ ধরা ও খাওয়া বন্ধ রাখা হলে এ মাছ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসেও প্রমত্ত পদ্মায় এক সময় ইলিশ মাছে ভরপুর থাকার কথা রয়েছে।