মূলত সব ঋতুতে এ রোগ কম-বেশি হলেও শীতের শেষে ও বসন্তকালে তা মহামারী আকার ধারণ করে। চিকেনপক্স বা জলবসন্ত অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ। ভেরিসেলা জোস্টার নামক এক ধরনের ভাইরাস এ রোগের কারণ। এ রোগের প্রথম বিবরণ পাই আমরা ৯০০ শতাব্দীতে। তখন এটাকে এক ধরনের শান্ত প্রকৃতির গুটিবসন্তই বলা হতো। কিন্তু ১৭৬৫ সালে ভোগেল এটার নামকরণ করেন ‘ভেরিসেলা’। ১৭৬৬ সালে মরটেম এর নাম দেন ‘চিকেনপক্স’।
১৯৬৭ সালে হেবারডেন গুটিবসন্ত বা স্মলপক্সের সাথে চিকেনপক্সের পার্থক্য স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন। ১৯৮০ সালের ৮ মে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এক সম্মেলনে ঘোষণা দেয় পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে স্মলপক্স। কিন্তু চিকেনপক্স নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলোতে চিকেনপক্স বা জলবসন্ত এক মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা। ভীষণ ছোঁয়াচে এ রোগটি ১০ বছরের নিচের শিশুদের সবচেয়ে আক্রমণ করে বেশি। তবে সব দেশে সব ধরনের লোকের মাঝে এ রোগের সংক্রমণ লক্ষ করা যায়। কেউ যদি এ রোগে আক্রান্ত রোগীর কাছাকাছি অবস্থান করে সেও এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
তবে একবার কেউ আক্রান্ত হলে তার শরীরে ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির ফলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার তেমন সম্ভাবনা থাকে না।
রোগের উপসর্গ কী প্রধান উপসর্গ হলোঃ
১. জ্বর এবং শরীরে র্যাশ বা ফুসকুড়ি ওঠা। শরীর ম্যাজম্যাজ করে, ব্যথা হয়।
২. র্যাশ বা ফুসকুড়ি প্রথম দিনেই উঠতে পারে। পিঠে ও বুকে এগুলো প্রথম দেখা যায়, পরে মুখে ও মাথায় ওঠে।
৩. পায়ের তলা ও হাতের তালুতে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।
৪. সাধারণত প্রথম দিনে ফুসকুড়ি-গুলোর মধ্যে পানি জমা হতে থাকে- দেখতে ফোস্কার মতো হয়। কোনো কোনো ফুসকুড়ি তরল পদার্থপূর্ণ, কোনো কোনোটি পুঁজে পূর্ণ হয়
৫. তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ফুসকুড়ি পুরোপুরি বিস্তার লাভ করে এবং সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
৬. শরীর চুলকাতে থাকে।
৭. এরপর ধীরে ধীরে ফুসকুড়ি শুকাতে শুরু করে এবং শুকানোর পর আস্তরণগুলো ঝরে যেতে থাকে। সাধারণত দু’সপ্তাহের মধ্যে শরীরের সব আস্তরণ ঝরে যায়।
রোগ ছড়ায় যেভাবেঃ
১. চিকেনপক্সে আক্রান্ত রোগীর হাঁচি ও কাশি থাকে।
২. আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে।
৩. আক্রান্ত রোগীর ব্যবহৃত জিনিস স্পর্শ করলে। আক্রান্ত রোগীর নিঃশ্বাসের বাতাস থেকে।
৫. আক্রান্ত রোগীর কাছাকাছি অবস্থান করলে সেখানকার বাতাসের মাধ্যমে।
৬. আক্রান্ত রোগীর শরীরে ফুসকুড়ি ওঠার পাঁচ দিন আগে থেকে এবং ফুসকুড়ি শুকিয়ে যাওয়ার ছয় দিনের মধ্যে কেউ সংস্পর্শে এলে। মনে রাখতে হবে ভেরিসেলা ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার সাথে সাথে উপসর্গ দেখা দেয় না।
সাধারণত ১৪-২১ দিন (মোটামুটিভাবে ১৭ দিন) পর্যন্ত রোগটি শরীরে সুপ্তাবস্থায় থাকে। পরে ধীরে ধীরে উপসর্গ দেখা দেয়।
রোগের চিকিৎসা:
চিকেনপক্সের রোগী সাধারণত এমনিতে ভালো হয়ে যায়। তবুও সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। রোগীর কষ্ট লাঘব করার জন্য এবং পরবর্তী সময়ে যাতে ইনফেকশন না হয়, সে জন্য কিছু ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে-
১. রোগীকে প্রথমত আলাদা ঘরে রাখতে হবে। রোগীর ত্বক পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রতিদিন বিছানার চাদর বদলাতে হবে।
২. চুলকানির জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ খেতে হবে।
৩. জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে।
৪. ইনফেকশন রোধ করার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পাঁচ-সাত দিন অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হবে।
৫. ত্বকে ইনফেকশন হলে মুখে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি ত্বকে ক্লোরহেক্সিডিন অ্যান্টিসেপটিক মলম লাগানো যেতে পারে।
রোগটি প্রতিরোধ:
চিকেনপক্স যেহেতু সংক্রামক ব্যাধি, তাই যেসব কারণে চিকেনপক্স হতে পারে সে কারণগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকলে এবং সেই মতো সাবধানতা অবলম্বন করলে চিকেনপক্সের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তবে যেসব শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের ‘হিউম্যান অ্যান্টিভেরিসেলা ইমিউনোগ্লোবিন’ ইনজেকশন দেয়া যেতে পারে। ‘ভেরিলরিক্স’ নামক একটি ভ্যাকসিন পাওয়া যায়, যা শিশুদের কিংবা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাউকে চিকেনপক্সের হাত থেকে রেহাই পেতে সাহায্য করবে। এ রোগের ফলে যেসব জটিলতা দেখা দিতে পারে-
নিউমোনিয়া, মস্তিষ্কের প্রদাহ, রক্তক্ষরণ, ত্বকের ইনফেকশন, হৃদপিণ্ডের মাংসপেশির প্রদাহ, কিডনির প্রদাহজনিত রোগ, রক্তের ইনফেকশন, গর্ভস্থ শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্মগত ত্রুটি ইত্যাদি হতে পারে।