ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজট ও দুর্ভোগ অব্যাহত রয়েছে। আর ফেরিস্বল্পতা ও নদীতে তীব্র স্রোতের কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটের দুই পাশে দীর্ঘ সময় আটকে থাকছে অসংখ্য যানবাহন। চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। যানজটে আটকে পড়ে গরমে অসুস্থ দুটি গরুর মৃত্যু হয়েছে দৌলতদিয়া ঘাটে। এমন পরিস্থিতিতে আজ থেকে মহাসড়কে শুরু হচ্ছে মূল ঈদযাত্রা। সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থার কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা। ঈদের সময় এই দুর্ভোগ আরও বাড়বে, এমন আশঙ্কা সাধারণ মানুষের। যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঈদের আগে সব সড়ক মেরামত করার নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু তাতে আশ্বস্ত হতে পারছে না ঘরমুখী মানুষরা। দুর্ভোগের ভয়ে এবার অনেকেই বাড়ি যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবার কেউ কেউ আগেভাগেই পরিবারের সদস্যদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বাসের টিকেট কাটার পরও ট্রেনে যাওয়ার মনস্থির করেছে রাজধানীর অনেকেই।
ঈদ ঘনিয়ে আসায় দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে কোরবানির গরুবাহী শত শত ট্রাক নদী পারাপার হতে দৌলতদিয়া ঘাটে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু ঘাটে এসে পশুবাহী ট্রাকগুলো অন্যান্য গাড়ির সঙ্গে সিরিয়ালে আটকা পড়েছে। গত শনিবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত যানবাহনের সারি দৌলতদিয়া ঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে গোয়ালন্দ রেলগেট পর্যন্ত অন্তত ৮ কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল। গরুবাহী ট্রাক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারাপার করতে যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে এক সিরিয়ালে দিলেও পর্যাপ্ত ফেরির অভাব ও নদীতে তীব্র স্রোতের কারণে ফেরিগুলো স্বাভাবিকভাবে চলাচল না করতে পারায় দীর্ঘ সময় আটকে থাকতে হচ্ছে গরুবোঝাই ট্রাক ও যাত্রীবাহী যানবাহনগুলোকে। সকালে সিরিয়ালে আটকে থেকে গরুবোঝাই ট্রাকের মধ্যেই দুটি গরুর মৃত্যু হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত গরু ব্যবসায়ী জানান, কুষ্টিয়ার বালিয়াপাড়া হাট থেকে ১৬টি বড় আকারের গরু কিনে ট্রাকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। গতকাল সকালে দৌলতদিয়া ঘাটে এসে ট্রাকটি সিরিয়ালে আটকে পড়ে। এর মধ্যে গরুগুলো অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিষয়টি তিনি কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে জানিয়ে তার ট্রাকটি সিরিয়াল থেকে ফাঁকা কোনো জায়গায় নিয়ে গরুগুলো ট্রাক থেকে নামানোর সুযোগ করে দিতে বলেন; কিন্তু তার কথা কেউ শোনেনি। এ অবস্থায় ট্রাকেই তার দেড় লাখ টাকা দামের একটি গরুর মৃত্যু হয়। এরপর তিনি মহাসড়কের পাশে দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুলের সামনে ট্রাকের অন্য গরুগুলো নামিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে ভোরে সিরিয়ালে আটকে থাকা একটি ট্রাকের ওপরই আরেকটি বড় গরুর মৃত্যু হয়।
মাগুরার কয়েকজন ব্যাপারিকে গোয়ালন্দ উপজেলা কমপ্লেক্সের সামনে ট্রাক স্কেল মেরামত করা মাটির টিবির ওপর ট্রাক থামিয়ে উপজেলা মাঠে সবগুলো গরু নামিয়ে এবং অসুস্থগুলোর পরিচর্যা করে আবার ট্রাকে তুলতে দেখা গেছে। একইভাবে ঘাটে আটকে থাকা আরও বহু গরু ও রাখালকে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখা গেছে।
একজন ট্রাকচালক জানান, তিনি ১২টি গরু নিয়ে ঢাকার উত্তরার উদ্দেশে যাচ্ছেন। প্রায় ২ ঘণ্টা হল সিরিয়ালে আটকে রয়েছেন। কখন ফেরির নাগাল পাবেন তা বুঝতে পারছেন না। আসলাম শেখ নামে এক ব্যক্তি জানান, তিনি এই ট্রাকে তিনটি গরু নিয়ে যাচ্ছেন। গরমে টিকতে না পেরে গরুগুলো আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে সুস্থ রাখা যাচ্ছে না।
ঝিনাইদহ থেকে ১৪টি গরু নিয়ে আসা ট্রাকচালক জানান, এ মুহূর্তে কোরবানির পশুবাহী গাড়িগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। তার ট্রাকে ১৩-১৪ লাখ টাকার গরু রয়েছে। একেকটি গরুর মূল্য ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হবে। এই গরুগুলো কোনোদিন এত গরম সহ্য করেনি। তাই অসুস্থ হয়ে মারা পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে যান পারাপার ব্যাহত হওয়ায় মহাসড়কে আটকা পড়েছে শত শত যাত্রীবাহী দূরপাল্লার বাস। গত শনিবারের নৈশকোচগুলো গতকাল বেলা ১১টায়ও ঘাট থেকে অনেক দূরে মহাসড়কে আটকে ছিল। বাসগুলো সারারাত যাত্রী নিয়ে মহাসড়কেই ছিল। ঈগল
পরিবহনের ঘাট ব্যবস্থাপক ভরত মণ্ডল জানান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ফেরির সংখ্যা না বাড়ালে এ অবস্থা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। তিনি বলেন, যাত্রীরা কী খাবে আর কোথায় প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারবে বলতে পারবেন? মহিলাদের কী অবস্থা একবার চিন্তা করেন। এছাড়া লঞ্চ পারাপার পরিবহনগুলোকে সিরিয়ালে আটকে না রেখে ঘাট পর্যন্ত যেতে দেওয়ার দাবি জানান। এতে কিছুটা ভোগান্তি কমবে বলে তিনি মনে করেন।
বিআইডব্লিউটিসির ভাসমান কারখানা মধুমতির প্রকৌশলী মো. এনামুল হক জানান, রো রো ফেরি আমানত শাহ ও কে-টাইপ ফেরি কাবেরী গত শনিবার রাতেই বহরে যোগ দিয়েছে। এতে ফেরির সংখ্যা ১৮টি হয়েছে। তবে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান নামে রো রো ফেরিটি তীব্র স্রোতের বিপরীতে চলাচল করতে পারছে না। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ফেরিটিকে দ্রুত সংস্কার করে রুটে নামানোর চেষ্টা চলছে।
কালিয়াকৈর সংবাদদাতা জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে গতকাল সকাল থেকেই কখনও থেমে থেমে, কখনও তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। মহাসড়কের জয়দেবপুর-চন্দ্রা অংশে কোনাবাড়ী বাইবাইল থেকে সফিপুর বাজার হয়ে চন্দ্রা এবং চন্দ্রা থেকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার এলাকায় গাড়ি ধীরগতিতে চলতে দেখা গেছে। চন্দ্রা ত্রিমোড়ে মহাসড়কের জোড়াতালির কাজ চলমান থাকায় এই যানজট আরও স্থায়ী হয়।
যাত্রী, পরিবহন শ্রমিক ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুরের বিভিন্ন অংশ ভাঙাচোরা থাকায় যানবাহন চলাচলের গতি পাচ্ছে না। ফলে গাজীপুরের কোনাবাড়ী ও কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক, সফিপুর, পল্লীবিদ্যুত্, চন্দ্রা, সাহেববাজার বাইবাসসহ বিভিন্ন স্থানে যানজট সৃষ্টি হয়। মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে ভাঙাচোরা, এলোমেলো যানবাহন চলাচল, সড়কে অবৈধ অটোরিকশা, এলোমেলো পার্কিং ও অতিরিক্ত যানবাহনের চাপের কারণে গত শনিবার সকাল থেকেই যানজট সৃষ্টি শুরু হয়। ওই যানজট কখনও থেমে থেমে, কখনও আবার তীব্র আকার ধারণ করে। এতে দুর্ভোগে পড়েছে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা। যানজট নিরসনে কালিয়াকৈর উপজেলার কয়েকটি স্থানে পুলিশ থাকলেও তাদের তেমন কোনো ভূমিকা চোখে পড়েনি।
সালনা/কোনবাড়ী হাইওয়ে থানার ওসি কাজী মোহাম্মদ হোসেন সরকার জানান, যানবাহনের অতিরিক্ত চাপের কারণে গত শনিবার সকাল থেকেই যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়ার রাতভর বৃষ্টির কারণে মহাসড়কে পাশ দিয়ে গাড়ি চলাচলে অসুবিধা হওয়ায় গতকাল যানজট সৃষ্টি হয়। যানজট নিয়ন্ত্রণে হাইওয়ে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।
কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, গত ক’দিন ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে যানজট থাকলেও গতকাল ভোর থেকেই যাত্রীবাহী ও মালবোঝাই যানবাহনের সংখ্যা কম থাকায় স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি যানবাহন কুমিল্লা অংশ অতিক্রম করছে। ফলে ভোগান্তির বদলে ঘরমুখো মানুষ ও যানবাহনের চালকদের মুখে ছিল স্বস্তি।
হাইওয়ে পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লার ময়নামতি ও দাউদকান্দি থানা ইলিয়টগঞ্জ ফাঁড়ি পুলিশ সূত্র জানায়, যানজট নিরসনে হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশও কাজ করছে। গতকাল অন্যান্য দিনের তুলনায় মহাসড়কে যানবাহন ও ঘরমুখো মানুষের সংখ্যা কম থাকায় কুমিল্লার দাউদকান্দি টোলপ্লাজা থেকে ময়নামতি সেনানিবাস পর্যন্ত এলাকায় কোনো যানজট ছিল না।