ভারতের স্বঘোষিত আধ্যাত্মিক গুরু গুরমিত রাম রহিম সিং ধর্ষণ মামলায় গতকাল দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এরপর থেকেই পাঞ্জাব, হরিয়ানাসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংসতা শুরু করে তার ভক্তরা। সংঘর্ষ আর পুলিশের গুলিতে সেখানে অন্তত ৩১ জন নিহত এবং ২০০ জনের বেশি আহত হয়েছে। সহিংসতার আশঙ্কায় আগে থেকেই সেনা-পুলিশ সব প্রস্তুত রেখেও পরিস্থিতি বাগে আনা যায়নি। লঠিচার্জ করে, কাঁদানে গ্যাস ছুড়েও পাঁচকুলা শহরের পরিস্থিতি পুলিশ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে শেষ পর্যন্ত সেখানে কারফিউ জারি করা হয়েছে। বিবিসি, আলজাজিরা, এনডিটিভি। স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার বিভিন্ন স্থানে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছে। দুটি রেলস্টেশনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে ধর্মগুরু রাম রহিমের ক্ষুব্ধ অনুসারীরা। দুটি থানায়ও অগ্নিসংযোগ করেছে তারা। এলাকার স্কুল ও অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ট্রেন ও রাস্তাঘাট বন্ধ রয়েছে। হাঙ্গামায় গ্রেফতারকৃতদের জন্য শহরের তিনটি স্টেডিয়ামকে অস্থায়ী জেলখানা বানানো হয়েছে। ধর্মীয় গোষ্ঠী ডেরা সাচ্চা সৌদার সদর দফতর সিরসায় এবং পাঁচকুলায় রাম রহিমের অনুসারীরা সংবাদ মাধ্যমকেও আক্রমণ করেছে।
সংবাদ কর্মীদের গাড়ি ভাঙচুর করেছে ক্ষুব্ধ ডেরা সমর্থকরা। গণমাধ্যমের একাধিক গাড়ি ও ভ্যান নষ্ট করেছে তারা। চণ্ডীগড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় শহরজুড়ে কয়েকটি স্থানে এবং পাঞ্জাবজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়েছে। পাঁচকুলার পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। সেখানে কারফিউ জারি করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আদালত চত্বরের বাইরে প্রচণ্ড গোলমাল চলছে। পাঁচকুলায় থানা এবং বিভিন্ন সরকারি দফতরে রাম রহিম ভক্তরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আগুন লাগানো হয়েছে বহু গাড়িতে। গোটা শহরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। পুলিশের সঙ্গে প্রবল সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে রাম রহিম সমর্থকরা। পুলিশ পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে গুলি চালানোতেই নিহতের ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যাচ্ছে। ২৮ জন নিহত হওয়া ছাড়াও সংঘর্ষে আহত অন্তত ২৫০ জন বলে খবরে জানানো হচ্ছে। তবে প্রশাসনিকভাবে হতাহতের সংখ্যার ব্যাপারে এখনও কিছু বলা হয়নি। ডেরা সাচ্চা সৌদার সদর দফতর হরিয়ানার সেই সিরসায়ও তাণ্ডব চলছে। পুলিশের সঙ্গে সেখানেও রাম রহিম ভক্তদের সংঘর্ষ হয়েছে। অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে দিল্লিতেও। রাজধানীর আনন্দ বিহার রেলওয়ে স্টেশনে একটি ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, বাসও জ্বালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে দিল্লি পুলিশ। হরিয়ানা ও পাঞ্জাবজুড়ে তাণ্ডবের মুখে দুই রাজ্যের সীমান্তই সিল করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ফোনে কথা বলেছেন পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র সিংহ এবং মনোহরলাল খট্টরের সঙ্গে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ রাম রহিম সমর্থকদের শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। বাবা রাম রহিম নিজেও শান্তিই চাইছেন বলে জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। রাম রহিম সিংয়ের লাখো সমর্থককে চণ্ডীগড়ে ঢুকতে দেওয়ার জন্য হরিয়ানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র সিং। চণ্ডীগড় দুই রাজ্যেরই রাজধানী। ধর্মগুরুর মামলার রায় শুনতে আগে থেকেই শহরটিতে রাম রহিমের দুই লাখের বেশি ভক্ত জড়ো হয়েছিল। আদালতের রায় বিপক্ষে গেলে সহিংসতা শুরু হতে পারে-এমন আশঙ্কায় সকাল থেকে পাঁচকুলায় সেনাবাহিনী নামানো হয়। ৫০ হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয় হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে। উত্তেজনার মধ্যেই সিরসায় নিজের সাংগঠনিক দফতর থেকে ১০০ গাড়িবহর নিয়ে রওনা হয়ে আড়াইশ কিলোমিটার দূরে পাঁচকুলা আদালতে পৌঁছেন রঙদার চরিত্র রাম রহিম সিং। আদালত দুপুরে রায় ঘোষণার পরপরই ৫০ বছর বয়সী রাম রহিমকে কড়া পাহারার মধ্যে আম্বালা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। রায় শোনার পর আদালতের বাইরে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার বহু সমর্থক। টেলিভিশন ফুটেজে ওই সময়ই রাম রহিমের অনুসারীদের সহিংসতায় লিপ্ত হতে দেখা গেছে। একাধারে ধর্মপ্রচারক, সমাজ সংস্কারক, গায়ক, চিত্রনায়ক ও পরিচালক বাবা রাম রহিমের মতো বর্ণময় চরিত্র ভারতের অজস্র ধর্মগুরুর মধ্যে বিরল। শিখ, হিন্দু, মুসলিম-সব ধর্মের চেতনা মিশিয়ে বাবা রাম রহিম তৈরি করেছেন তার আশ্রম-ডেরা সাচ্চা সৌদা। হরিয়ানায় গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন রাম রহিম। লাখ লাখ ভক্ত থাকায় বড় ভোটব্যাংক বিবেচনা করে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির অনেক নেতাই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাখেন। কিন্তু ১৫ বছর আগে নিজের আশ্রমেই দুজন ভক্ত মহিলাকে ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির চিঠির সূত্র ধরে ২০০২ সালে এই ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করে সিবিআই। সেখানে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে নিজের আশ্রমে দুই শিষ্যাকে ধর্ষণ করেন রাম রহিম। ২০০৭ সালে শুনানি শুরুর পর ১০ বছরের মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে। বিচারের পুরোটা সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এসেছেন ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রধান।