কৃষি ডেস্কঃ বাংলাদেশের পেঁয়াজ গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। মসলা ও সবজি হিসাবে ব্যবহার হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে মাত্র ২৮৫.৬৬ হাজার একর জমিতে প্রতি বছর প্রায় ৭ লক্ষ ৬৯ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই পেঁয়াজের চাষ দেখা যায়। পেঁয়াজের চাষ শুধু শীতকালেই হয় না এখন বর্ষাকালেও চাষ করা হচ্ছে।
পুষ্টিমূল্যঃ এত প্রচুর ক্যালসিয়াম ও সামান্য ভিটামিন ‘সি’ আছে।
ভেষজ গুণঃ
ব্যবহারঃ তরকারীতে মসলা হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও বিভিন্ন মুখরোচক খাবার তৈরিতে পেঁয়াজের ব্যবহার রয়েছে।
উপযুক্ত জমি ও মাটিঃ উর্বর বেলে-দো-আঁশ মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য অতি উত্তম। বর্ষায় পেঁয়াজ চাষের জন্য উঁচু জমি দরকার যেখানে বৃষ্টির পানি জমেনা। জমিতে সেচ ও পানি নিকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
জাত পরিচিতিঃ
বারি পেঁয়াজ-১: জাতটির কন্দ অধিক ঝাঁঝযুক্ত। প্রতিটি গাছে ১০-১২টি পাতা হয়। হেক্টর প্রতি ফলন ১২-১৬ টন। হেক্টর প্রতি বীজের ফলন ৬০০-৬৫০ কেজি। বারি পেঁয়াজ-১ পার্পল ব্লচ ও স্টেমফাইলাম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন। জাতটি রবি মৌসুমে চাষ উপযোগী।
বারি পেঁয়াজ-২: জাতটি বিশেষভাবে খরিফ মৌসুমে অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে স্বল্প সময়ের ফসল। এটি দেখতে গোলাকার ও লাল রঙের। আগাম চাষের জন্য মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বীজ তলায় বীজ বোনা যায় এবং এপ্রিল মাসে ৪০-৪৫ দিনের চারা মাঠে রোপণ করা যায়। নাবী চাষের জন্য জুন-জুলাই মাসে বীজতলায় বীজ বুনতে হয়। প্রতি হেক্টরে (২৪৭ শতকে) ফলন ২২ টন।
বারি পেঁয়াজ-৩: জাতটি বিশেষভাবে খরিফ মৌসুমে অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে স্বল্প সময়ের ফসল। এটি দেখতে গোলাকার ও লাল রঙের। বীজ বোনার জন্য মধ্য জুন থেকে মধ্য জুলাই মাস উপযুক্ত সময়। আগাম চাষে বীজ বোনার উপযুক্ত সময় হচ্ছে মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ এবং এপ্রিল মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
বারি পেঁয়াজ-৪: এটি উচ্চ ফলনশীল শীতকালীন পেঁয়াজ। আকৃতি গোলাকার, রং ধুসর লালচে বর্ণের ও ঝাঁঝযুক্ত। হেক্টর প্রতি ফলন ১৭-২২ টন।
বারি পেঁয়াজ-৫: এ জাতটি গ্রীষ্মকালে চাষের উপযোগী স্বল্প সময়ের ফসল। এটি সারা বছরব্যাপী চাষ করা যেতে পারে। বীজ থেকে ফসল উত্তোলন পর্যন্ত ৯৫-১১০ দিন সময় লাগে। হেক্টর প্রতি গড় ফলন ১৮-২০ টন।
স্থানীয় জাতঃ স্থানীয় জাতের মধ্যে তাহেরপুরী, ফরিদপুরের ভাতি, ঝিটকা, কৈলাসনগর উল্লেখযোগ্য। আগাম রবি মৌসুমে এ জাত দুটির ফলন দ্বিগুন হয় এবং কন্দের মানও উন্নত হয়। উদ্ভাবিত ও উল্লেখিত পেঁয়াজের জাত দুইটি উত্তরবঙ্গ, কুষ্টিয়া, যশোর ও ফরিদপুর অঞ্চলে ব্যবসায়িক ভাবে চাষ করার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ভাল বীজের বৈশিষ্ট্যঃ
চারা তৈরিঃ ৩x১ মিটার আকারের প্রতি বীজতলার জন্য ২৫-৩০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। পেঁয়াজ রবি ও খরিপ মৌসুমে চাষ করা যায়। খরিপ মৌসুমে চাষের জন্য জুলাই-আগষ্ট (শ্রাবণ-ভাদ্র) ও রবি মৌসুমে চাষের জন্য ফেব্রুয়ারী-মার্চ (মাঘ-ফাল্গুন) মাসে বীজ তলায় বীজ বপন করতে হয়। জমির আগাছা পরিষ্কার করে ভালভাবে চাষও মই দিয়ে ৩x১ মিটার আকারের বীজতলা করে এক সপ্তাহ রাখা হয়। বীজ বপনের পূর্বে আগের দিন সন্ধ্যায় বীজ ভিজিয়ে রেখে পরের দিন তুলে ১ ঘন্টা রৌদ্রে শুকিয়ে তারপর বীজতলায় বপন করতে হবে। বীজ বপনের পর ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে। বীজ বপনের পরদিন বেডে ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দিনের বেলা বীজতলা ঢেকে রাখতে হবে এবং রাত্রে খোলা রাখতে হবে। প্রয়োজনে ঝরনা দিয়ে পানি দিতে হবে।
চারা রোপনঃ ৫ টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করা হয়। ১৫x১০ সে.মি. দূরত্বে চারা রোপন করা হয়। বর্ষার সময় ১ মিটার চওড়া ও ১৫ সে.মি. উঁচু বেড তৈরি করে চারা রোপণ করা হয়। দুই বেডের মাঝে ৩০ সে.মি. চওড়া পানি নিকাশের নালা রাখা হয়। ৪০-৪৫ দিন বয়সের চারা লাগানোর উপযোগী হয়।
সার ব্যবস্থাপনাঃ পেঁয়াজের জমিতে প্রতি হেক্টরে গোবর ৮-১০ টন, ইউরিয়া ২৫০-২৭০ কেজি, টিএসপি ১৯০-২০ কেজি এবং ১৫০-১৭০ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করা হয়। জমি তৈরির সময় ১৬০-১৭০ কেজি ইউরিয়া ও বাকী সমুদয় সার মাটিতে মেশাতে হয়। চারা রোপনের ২০ দিন পর বাকী ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করা হয়।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনাঃ জমিতে রসের অভাব থাকলে সেচ দিতে হবে। বর্ষা মৌসুমে যাতে বৃষ্টির পানি দাঁড়াতে না পারে সেজন্য নিকাশ নালা রাখতে হবে। জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। সেচের পর জমি নিড়ানি দিয়ে আলগা করে দিতে হবে। পেঁয়াজের কন্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফুলের কুঁড়ি দেখামাত্র ভেঙ্গে দিতে হবে।
রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনাঃ
পোকার নামঃ থ্রিপস
এ পোকা ছোট কিন্তু পাতার রস চুষে খায় বিধায় গাছ দূর্বল হয়ে পড়ে। সে কারনে ক্ষেতের মধ্যে পাতা বিবর্ণ দেখালে কাছে গিয়ে মনোযোগ সহকারে দেখা উচিৎ, তা না হলে ফলন অনেক কমে যাবে। পোকা আকৃতিতে খুব ছোট। স্ত্রী পোকা সরু, হলুদাভ। পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ গাঢ় বাদামী। বাচ্চা সাদা বা হলুদ। এদের পিঠের উপর লম্বা দাগ থাকে।
ক্ষতির নমুনাঃ এরা রস চুষে খায় বলে আক্রান্ত পাতা রূপালী রং ধারণ করে। আক্রান্ত পাতায় বাদামী দাগ বা ফোঁটা দেখা যায়। অধিক আক্রমণে পাতা শুকিয়ে যায় ও ঢলে পড়ে। রাইজোম আকারে ছোট ও বিকৃত হয়।
জীবন চক্রঃ স্ত্রী পোকা পাতার কোষের মধ্যে ৪৫-৫০ টি ডিম পাড়ে। ৫-১০ দিনে ডিম হতে নিম্ফ (বাচ্চা) বের হয়। নিম্ফ ১৫-৩০ দিনে দুটি ধাপ অতিক্রম করে। প্রথম ধাপে খাদ্য গ্রহণ করে এবং দ্বিতীয় ধাপে খাদ্য গ্রহণ না করে মাটিতে থাকে। এরা বছরে ৮ বার বংশ বিস্তার করে। এবং স্ত্রী পোকা পুরুষ পোকার সাথে মিলন ছাড়াই বাচ্চা দিতে সক্ষম।
ব্যবস্থাপনাঃ সাদা রংয়ের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার। ক্ষেতে মাকড়সার সংখ্যা বৃদ্ধি করে এ পোকা দমন করা যায়। আক্রমণ বেশি হলে সাইপারমেক্সিন গ্রুপের সাইপেরিন, সাইপার অথবা ইমাডিক্লোরো ফিড গ্রুপের এডমায়ার প্রতি লিটারে ১ মিলি সাইপারমেক্সিন অথবা ইমিডা ক্লোরোফিড প্রতি লিটারে ০.৫ মিলি গাছে ৪ থেকে ৫ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
পোকার নামঃ জাব পোকা
ক্ষতির নমুনাঃ জাব পোকা দলবদ্ধভাবে পেঁয়াজ পাতার রস চুষে খায়, ফলে গাছ দূর্বল ও হলুদাভ হয়ে যায়। জাব পোকার মলদ্বার দিয়ে যে তরল পদার্থ বের হয় তাকে ’হানিডিউ’ বলে যা পাতায় আটকে গেলে সুটি মোল্ড নামক কালো ছত্রাক জন্মায়। ফলে গাছের সবুজ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ব্যবস্থাপনাঃ আক্রমণ বেশি হলে সাইপারমেক্সিন গ্রুপের সাইপেরিন, সাইপার অথবা ইমাডিক্লোরো ফিড গ্রুপের এডমায়ার প্রতি লিটারে ১ মিলি সাইপারমেক্সিন অথবা ইমিডা ক্লোরোফিড প্রতি লিটারে ০.৫ মিলি গাছে ৪ থেকে ৫ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
রোগের নামঃ পার্পল ব্লচ/ব্লাইট
এ রোগ পেঁয়াজের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। যে কোন বয়সে গাছের পাতা ও কান্ড আক্রান্ত হয়। অধিক আক্রমনে পেঁয়াজে ফুল আসে না ও ফসল কম হয়। আক্রান্ত বীজ বেশিদিন গুদামে রাখা যায়না। বাজার মূল্য কমে যায়। অল্টারনারিয়া পোরি ও স্টেমফাইলিয়াম বট্রাইওসাম নামক ছত্রাকদ্বয় দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
ক্ষতির নমুনাঃ কান্ডে প্রথমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানি ভেজা হালকা বেগুনী রংয়ের দাগের সৃষ্টি হয়। দাগগুলি বৃদ্ধি পেয়ে বড় দাগে পরিণত হয় এবং আক্রান্ত স্থান খড়ের মত হয়ে শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত পাতা ক্রমান্বয়ে উপরের দিক হতে মরতে শুরু করে। পাতা বা কান্ডের গোড়ায় আক্রান্ত স্থানের দাগ বৃদ্ধি পেয়ে হঠাৎ পাতা বা বীজবাহী কান্ড ভেঙ্গে পড়ে এতে বীজ অপুষ্ট হয় ও ফলন কম হয়। বৃষ্টিপাত হলে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। আক্রান্ত বীজ, গাছের পরিত্যাক্ত অংশ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে।
ব্যবস্থাপনাঃ রোগ প্রতিরোধী বা সহনশীল জাত ব্যবহার। রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার। ফসল পর্যায় অনুসরন করা অর্থ্যাৎ একই জমিতে পর পর কমপক্ষে ৪ বছর পেঁয়াজ না করা। পেঁয়াজ গাছের পরিত্যাক্ত অংশ, আগাছা ধ্বংস করা। ম্যানকোজেব গ্রুপের এগ্রিজে ডাইথেনএম-৪৫ অথবা ব্যাভিষ্টিন (কার্ববোন্ডাজিম) ছত্রাকনাশক প্রতি কেজি বীজে ১০০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধণ করে বপন করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে প্রতিলিটার পানিতে রোভরাল বা এন্ট্রাকল ২ গ্রাম ও এগ্রিজে, ডাইথেন এম-৪৫ বা ফলিকিউর (টেবুকোনাজল) ১০ লিটার পানিতে .০৫ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
রোগের নামঃ কান্ড পঁচা
স্কেলরোসিয়াম রলফসি ও ফিউজারিয়াম নামক ছত্রাক দ্ধারা এ রোগ হয়। যে কোন বয়সে গাছ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। কন্দ ও শিকড়ে এর আক্রমণ দেখা যায়। আক্রান্ত কন্দে পচন ধরে এবং আক্রান্ত কন্দ গুদামজাত করে বেশী দিন রাখা যায় না।
ক্ষতির নমুনাঃ আক্রান্ত গাছের পাতা হলদে হয়ে যায় ও ঢলে পড়ে। টান দিলে আক্রান্ত গাছ খুব সহজে মাটি থেকে কন্দসহ উঠে আসে। আক্রান্ত স্থানে সাদা সাদা ছত্রাক এবং বাদামী বর্ণের গোলাকার ছত্রাক গুটিকা (স্কেলরোসিয়াম ) দেখা যায়। অধিক তাপ ও আর্দ্রতা পূর্ণ মাটিতে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ক্ষেতে সেচ দিলেও এ রোগ বৃদ্ধি পায়। এ রোগের জীবাণু মাটিতে বসবাস করে বিধায় সেচের পানির মাধ্যমে ও মাটিতে আন্ত পরিচর্যার সময় কাজের হাতিয়ারের মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার হয়।
ব্যবস্থাপনাঃ আক্রান্ত গাছ তুলে ধ্বংশ করতে হবে। মাটি সব সময় স্যাঁত স্যাঁতে রাখা যাবে না। আক্রান্ত জমিতে প্রতি বছর পেঁয়াজ /রসুন চাষ করা যাবে না। ম্যানকোজেব গ্রুপের এগ্রিজে ডাইথেনএম-৪৫ অথবা ব্যাভিষ্টিন (কার্ববোন্ডাজিম) ছত্রাকনাশক প্রতি কেজি বীজে ১০০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধণ করে বপন করতে হবে।
ফসল সংগ্রহঃ
উপযোগী বৈশিষ্ট্যঃ পেঁয়াজ গাছ পরিপক্ক হলে পাতা ক্রমান্বয়ে হলুদ হয়ে হেলে পড়ে। জমির প্রায় ৭০-৮০% গাছের এ অবস্থা হলে পেঁয়াজ তোলার উপযোগী হয়।
সংগ্রহের সময়ঃ পেঁয়াজ গাছের ঘাড় বা গলা শুকিয়ে ভেঙ্গে গেলে বা নরম মনে হলে বুঝতে হবে যে পেঁয়াজের উত্তোলনের সময় হয়েছে।
কতদিন লাগবেঃ বীজ বপন থেকে ফসল উত্তোলন পর্যন্ত প্রায় ১১০ থেকে ১২০ দিন সময় লাগে।
ফলনঃ সাধারণতঃ বর্ষা মৌসুমে ৩৫-৪৫ দিন এবং রবি মৌসুমে ৪০-৫৫ দিনের মধ্যে পেঁয়াজ তোলার উপযুক্ত হয়। রবি মৌসুমে পেঁয়াজের পাতা মরে গেলে (গলা চিকন হলে) গাছ সমেত পেঁয়াজ তুলে এনে পাতা শুকিয়ে মরা পাতা কেটে সংরক্ষণ করা হয়। প্রতি হেক্টরে ফলন রবিতে ১২-১৬ টন ও খরিপ ১০-১২ টন।
পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন
রোপণ সময়ঃ নভেম্বর মাসের প্রথম ভাগে শল্ককন্দ মাঠে রোপণ করতে হয়।
জীবনকালঃ ফসল উত্তোলন পর্যন্ত ৯০-১০০ দিন সময় লাগে। এ বীজ ফসল আবাদের জন্য দূরত্বঃ সারি থেকে সারি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ৮×৬ ইঞ্চি।
ওজনঃ প্রতিটি বীজ কন্দের ওজন ১২ থেকে ১৫ গ্রাম হওয়া দরকার।
সারঃ গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ সারের প্রয়োজন হয়, বীজ উৎপাদনেও সে পরিমাণ সারের প্রয়োজন হয়। ফুল আসার পর একরপ্রতি অতিরিক্ত ৪০ কেজি ইউরিয়া ও ১০০ কেজি এমপি সার পেঁয়াজের জমিতে ছিটিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে এবং গাছের গোড়া ঝুরঝুরা মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া প্রয়োজন, যাতে রোপণকৃত বীজ পেয়াজগুলো মাটির নীচে থাকে।
লক্ষ্যণীয়ঃ পেঁয়াজের জাতকে ঠিক রাখার জন্য বীজ ফসলের চতুর্দিকে ১০০০ মিটারের মধ্যে অন্য কোনো পেঁয়াজের জাত থাকা ঠিক নয়।
গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ
জাতঃ বাংলদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা পেঁয়াজের ঘাটতি মিটানোর জন্য গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের কয়েকটি জাত আবিষ্কার করেছেন। এগুলো হলো-
চাষের সুবিধাঃ
স্থান নির্বাচনঃ বৃষ্টিপাত অল্প হয় এ রকম অঞ্চলের জন্য বারি পেঁয়াজ ২ ও বারি পেঁয়াজ ৩ চাষের জন্য উপযোগী।
চাষের জন্য পরিবেশ ও মাটি
জলবায়ু |
তাপমাত্রা |
মাটির ধরণ |
গ্রীষ্ম কাল |
পেঁয়াজ উৎপাদনের উপযোগী তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সে.। |
পানি জমে না এমন দো-আঁশ, এটেল দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও পলিযুক্ত মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য উত্তম। |
জমি তৈরী
বীজতলা তৈরি ও চারা উৎপাদনঃ ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে চারা উৎপাদন
বেড তৈরি ও আগাছা পরিষ্কারঃ প্রথমে জমি ভালোভাবে চাষ দিয়ে আগাছা সম্পূর্ণরূপে তুলে ফেলতে হবে। তারপর বেড তৈরি করে এক সপ্তাহ রেখে দিতে হবে। এক সপ্তাহ পর বেডগুলি পুনরায় কুপিয়ে আগাছা বেছে ফেলে বীজ বপন করতে হবে।
বপনের জন্য বীজ প্রস্তত করাঃ বপনের আগে বীজ কমপক্ষে এক ঘন্টা রোদে শুকাতে হবে। তারপর বীজ ছায়ায় রেখে ঠান্ডা করে নিতে হবে। অতপর বীজ সন্ধ্যায় ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে উঠাতে হবে। বীজগুলি পানি থেকে উঠানোর পর গামছা বা পাতলা কাপড়ের ব্যাগে ঝুল অবস্থায় রেখে সম্পূর্ণ পানি মুক্ত করে নিয়ে ঝুরঝুরে অবস্থায় এলে বীজ বপন করতে হবে।
বীজ বপনের পর করণীয়ঃ বীজ বপনের পর আলাদা ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে বীজগুলি ঢেকে দিতে হবে। তারপর হাত বা কলাগাছের টুকরা দিয়ে মাটি সুন্দরভাবে চেপে শক্ত করে দিতে হবে। বীজ ফেলার পরদিন বেডে ছায়া দেওয়ার জন্য প্রতি বেডে ৫টি করে বাঁশের বাতি অর্ধ চন্দ্রকারে এমনভাবে বসানো হয় যেন বাতির দুই মাথা ড্রেনের মধ্যে থাকে এং বেডের ঠিক মাঝখান হতে বাঁশের বাতির উচ্চতা ১৮ইঞ্চি হয়। পরের দিন পানি দিয়ে বীজতলা এমনভাবে চট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যেন চটের দুই মাথা খোলা থাকে। বীজ গজানোর পূর্বে দিনের বেলা বীজতলা ঢেকে রাখতে হবে এবং রাতে খোলা রাখতে হবে। প্রয়োজন বোধে বীজতলায় ঝরণা দিয়ে পানি দিতে হবে।
বীজ গজানোর পর করণীয়ঃ বীজ গজানোর পর সকাল ও বিকাল ছাড়া অবশিষ্ট সময় বীজতলা ঢেকে রাখতে হবে। চারা যত বড় হতে থাকবে ঢাকার সময় তত কমাতে হবে। চারার দৈর্ঘ্য .৫ থেকে ১ ইঞ্চি হলে আর ঢাকার প্রয়োজন হবে না। বীজতলায় এক সপ্তাহ পর পর রিডোমিল অথবা রোভরাল দুই গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ডেম্পিং অফ রোগ দমনের জন্য স্প্রে করতে হবে। ৩৫ থেকে ৪০ দিন বয়সের চারা রোপণের উপযুক্ত হয়।
বীজতলায় রস না থাকলে চারা উত্তোলনের এক ঘন্টা পূর্বে ঝরণা দিয়ে সেচ দিতে হবে আর রস থাকলে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
চারা উঠানোর সময়ঃ চারা দিনের যে কোন সময় উঠানো যেতে পারে।
জুলাই ও আগস্ট মাসে চারা উৎপাদনঃ এই পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি, বীজবপন, বীজতলার যত্ন ও চারা উত্তোলন পদ্ধতি ছায়া পদ্ধতির ন্যায়। তবে এক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি বীজতলার চারা রৌদ্র পাওয়ার জন্য চটের পরিবর্তে পাতলা সাদা রংঙের পলিথিন পেপার দিয়ে বীজতলা ঢেকে দিতে হবে। বৃষ্টির সময় বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং রৌদ্র হলে পলিথিন খুলে দিতে হবে। বীজতলার পরিচর্যা ও চারা উঠানো পদ্ধতি একই রকম।
উভয় সময়ের জন্য বীজ বপন
বীজতলায় বীজ বপনের সময় |
মূল জমিতে চারা রোপণের ৪০ থেকে ৪৫ দিন পূর্বে |
বীজতলার আকার |
বীজতলা ৩x১ মিটার বা (১০x৩ ফুট) আকারে হতে হবে |
বীজের প্রয়োজন |
প্রতি বীজতলার জন্য ২৫-৩০ গ্রাম |
একর প্রতি বীজ |
১.৫ কেজি |
বীজ গজানোর হার |
৭০ থেকে ৭৫ ভাগ হতে হবে |
প্রতি একর জমির জন্য বীজতলার প্রয়োজন |
৪০ থেকে ৫০ টি |
বীজ বপনের দূরত্ব |
বীজতলায় ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পরপর সারি করে বীজ বপন করতে হবে |
মুল জমি তৈরিঃ অবস্থাভেদে ৩ থেকে ৪টি চাষ ও মই দিয়ে খুব ভালভাবে মাটি প্রস্তত করতে হয়।
রোপণ পদ্ধতিঃ
রোপণের সময় |
আগামঃ ১ ফেব্রুয়ারি হতে ৩০ মার্চ (মধ্য মাঘ-মধ্য চৈত্র) মাসের মধ্যে এবং নাবীঃ ২৫ আগস্ট হতে ১০ অক্টোবর (মধ্য ভাদ্র-আশ্বিনের শেষ) মধ্যে |
চারার বয়স |
৩৫ থেকে ৪০ দিন বয়সের চারা মূল জমিতে রোপণ করতে হয় |
উচ্চতা |
৬ থেকে ৮ ইঞ্চি |
রোপণ দূরত্ব |
সারি থেকে সারি ৬ ইঞ্চি এবং চারা থেকে চারা ৩ ইঞ্চি |
রোপণের সময় করণীয় |
চারার পাতার ১/৩ অংশ এবং শিকড়ের ৩/৪ অংশ কেটে ফেলতে হবে |
লক্ষ্যণীয়ঃ খরা মৌসুমে চারা রোপণ করলে রোপণের পর জমিতে প্লাবন সেচ দিতে হবে। অন্য মৌসুমে চারা রোপণ করলে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। চারা রোপণের সময় কিছু চারা বীজতলায় রেখে দিতে হবে। কারণ রোপণের ১০/১২ দিন পর যদি জমিতে কোন চারা মারা যায় তাহলে সেই স্থানে বীজতলার চারা পুনঃ রোপণ করতে হবে।
চাষের সময়ের পরিচর্যা
সেচ ব্যবস্থাঃ
গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চারা রোপণের পরপরই যদি কোন কারণে জমিতে রস না থাকে তবে একটা হালকা সেচ জরুরী। এছাড়া যদি জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকে এবং পরিমিত বৃষ্টি না হয় মাঝে মাঝে হালকা সেচ দিতে হবে।তাই গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সেচের গুরুত্ব অনেক। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য ১০ থেকে ১৫ দিন পরপর মোট ৫ থেকে ৬ টি সেচ প্রদান করতে হয়।
পানি বের করে দেওয়াঃ বর্ষাকালে জমিতে বৃষ্টি বা অন্য কোন কারণে যদি পানি জমে যায় তবে দ্রুত পানি বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ পেঁয়াজ গাছ জমানো পানি সহ্য করতে পারে না। তাই জমি তৈরীর পূর্বেই প্রয়োজনীয় নালা কেটে রাখতে হয়। বর্ষাকালে প্রতিটি বেডের চার পাশে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি উচুঁ আইল তৈরি করে দিতে হয়। তবে পানি বের করার জন্য এক পাশ দিয়ে আইল কেটে রাখতে হয়।
সারের মাত্রা ও প্রয়োগঃ গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জমিতে নিম্ন বর্ণিত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।
সার |
মোট পরিমাণ (একর প্রতি) |
শেষ চাষের সময় দেয় |
পরবর্তী পরিচর্যা হিসাবে দেয় (২০ দিন পর) |
গোবর |
২০০০ কেজি |
সব |
- |
ইউরিয়া |
৮২ কেজি |
৫০ কেজি |
৩২ কেজি |
টিএসপি |
১১০ কেজি |
সব |
- |
এমপি |
৬০ কেজি |
সব |
- |
জিপসাম |
৪৫ কেজি |
সব |
- |
আগাছা দমনঃ গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জমিতে প্রচুর আগাছা জন্মে। তাই চারা লাগানোর পর প্রথম ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে প্রথমবার আগাছা পরিস্কার করতে হয়। এই ভাবে মোট ৩ থেকে ৪ বার আগাছা পরিস্কার করার প্রয়োজন হয়। আগাছ পরিস্কারের জন্য ছোট কোদাল ব্যবহার করা ভাল।
জমিতে খড় বিছানোঃ পেঁয়াজের জমিতে মাটির জোঁ আসার সাথে সাথে ভালভাবে জমিতে খড় বিছিয়ে চটা ভেংগে দিতে হয়।
ফসল সংগ্রহঃ গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আগাম চাষে সাধারণতঃ চারা রোপণের ৮০ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে এবং নাবী চাষে চারা রোপণের ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে পেঁয়াজ সংগ্রহের উপযোগী হয়ে যায়। পেঁয়াজ সংগ্রহের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে গাছের ডগা ভেংগে দিলে ফলন ভাল পাওয়া যায়।
ফলনঃ সঠিক মাত্রা সার ও অন্যান্য পরিচর্যা করে গ্রীষ্মকালীন আগাম চাষে প্রতি একরে ৮ হাজার কেজি এবং গ্রীষ্মকালীন নাবী চাষে প্রতি একরে ৯ হাজার থেকে সারে ৯ হাজার কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব।
(সংগ্রহীত)