মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও রাষ্ট্রপক্ষের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে।
মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) আপিল বিভাগের রায়ের অনুলিপি হাতে পেয়েছেন বলে জানান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম।
আমৃত্যু কারাদণ্ডের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে উভয়পক্ষের আবেদন খারিজ করে গত ১৫ মে এ রায় দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে ৫ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। রায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়। অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় পুনর্বহাল চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আর সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে দেওয়া আমৃত্যু কারাদণ্ড থেকে খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন জানিয়েছিলেন সাঈদী। ওই দুই আবেদনের শুনানি একসঙ্গে নেওয়া হয়।
গত ১৪ মে শুরু হওয়া দু’দিনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে অংশ নেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সাঈদীর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল-১।
এ রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২৮ মার্চ পৃথক দু’টি আপিল দাখিল করেন সাঈদী ও সরকারপক্ষ। ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা ঘোষিত না হওয়া ৬টি অভিযোগে শাস্তির আরজি জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আর ফাঁসির রায় বাতিল করে সাঈদীর খালাস চেয়ে আপিল করেন আসামিপক্ষ।
আপিল শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন সে সময়কার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।
বিচারপতিদের মধ্যে মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা সব অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেন। আর বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী আসামির মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে রায় দেন। তবে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর মতামতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় আসে।
২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর আপিল মামলা দু’টির ৬১৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর গত বছরের ১২ জানুয়ারি পুনর্বিবেচনার আবেদন জানান রাষ্ট্রপক্ষের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। ৩০ পৃষ্ঠার মূল আবেদনসহ ৬৫৩ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে সাঈদীকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির দণ্ডাদেশ পুনর্বহালে ৫টি যুক্তি দেওয়া হয়েছে।
এর পাঁচদিন পর ১৭ জানুয়ারি করা ৯০ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ১৬ যুক্তিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড থেকে খালাস ও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন সাঈদী।
দীর্ঘদিন পরে আবেদন দু’টি কার্যতালিকায় আসার পর গত ০৬ এপ্রিল আসামিপক্ষের আইনজীবীর আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৪ মে রিভিউ শুনানির দিন ধার্য করেন সর্বোচ্চ আদালত।
সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, নয়জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর এবং ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরে বাধ্য করার ২০টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিলো ট্রাইব্যুনালে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাঈদীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণের আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে দু’টি অপরাধে অর্থাৎ ৮ ও ১০নং অভিযোগে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে আগুন দেওয়ার দায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। প্রমাণিত অন্য ৬টি অর্থাৎ ৬, ৭, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯নং অভিযোগে আলাদাভাবে কোনো সাজা দেননি ট্রাইব্যুনাল।
আর সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে ৫টি অভিযোগ। এর মধ্যে ২টিতে অর্থাৎ ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে হত্যা, নিপীড়ন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরে বাধ্য করায় আমৃত্যু এবং একটিতে অর্থাৎ ১০ নম্বর অভিযোগে হত্যা, নিপীড়ন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মান্তরে বাধ্য করা ও এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতার অপরাধে যাবজ্জীবন পেয়েছেন সাঈদী। একটিতে অর্থাৎ ৮ নম্বর অভিযোগে হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে ফাঁসির রায় দিলেও আপিল বিভাগ অভিযোগের একাংশের জন্য সাঈদীকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অন্য অংশের জন্য খালাস দিয়েছেন। একটিতে অর্থাৎ ৭ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সহযোগিতার জন্য ১০ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে সাঈদীকে।
এছাড়া ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ আপিল বিভাগের রায়ে প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি।
বাকি ১২টি অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৯, ১২, ১৩, ১৫, ১৭, ১৮ ও ২০ নম্বর অভিযোগে প্রমাণিত না হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে এসব অভিযোগ থেকে খালাস পান সাঈদী। রাষ্ট্রপক্ষ এসব অভিযোগে আপিল বিভাগের কাছে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘ন্যায়বিচার’ প্রার্থনা করেছিলেন। আপিলের রায়ে ট্রাইব্যুনালের এ খালাসের রায় বহাল রয়েছে।