মিয়ানমারে সহিংসতার শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই কক্সবাজারে মূল শহরে প্রবেশ করছে বলে তথ্য আছে প্রশাসনের কাছে। রোহিঙ্গারা গণহারে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ছড়িয়ে পড়লে পর্যটন শিল্প হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাহাড় এবং সমুদ্রের মিতালী দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পর্যটকরা হয়রানির শিকার হলে তারা আগ্রহ হারাবেন। এতে কক্সবাজার সম্পর্কে পর্যটকদের কাছে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে যাবে।
ট্যুরিস্ট পুলিশসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজারে মূল সমুদ্র সৈকত, সেন্টমার্টিন, ইনানি সৈকতসহ বিভিন্ন স্পটে ভ্রাম্যমাণ চা, সিদ্ধ ডিম, ঝিনুকের মালা বিক্রির কাজ করেন রোহিঙ্গারা। পর্যটকদের উত্যক্ত করার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রচুর নারী-পুরুষ ও শিশু পর্যটন স্পটে ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। তারাও পর্যটকদের হয়রানির সঙ্গে জড়িত। এছাড়া বিভিন্ন সময় সৈকতে ছিনতাই, চুরির যে অভিযোগ পাওয়া যায় তার সঙ্গেও রোহিঙ্গাদের জড়িত থাকার তথ্য আছে পুলিশের কাছে।
এই অবস্থায় স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা এবং কক্সবাজারের নাগরিকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
ট্যুরিস্ট স্পটে কোনোভাবেই রোহিঙ্গারা যেন আসতে না পারে, তারা যাতে ক্যাম্প ছেড়ে বেরুতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু অবস্থা যেটা দেখা যাচ্ছে, পুরনোরা তো ছড়িয়ে আছেই। ইতোমধ্যে যেসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছেন তাদের অনেকেই শহরে এসে গেছেন। পুলিশ-বিজিবি, প্রশাসনের সব পর্যায় থেকে এটা ঠেকানোর কাজ শুরু করতে হবে। না হলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প বাঁচানো যাবে না।
সূত্রমতে, প্রতিবছর অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুম থাকে। এসময় লাখ লাখ পর্যটকের পদভারে মুখরিত থাকে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, মহেশখালী এলাকার পর্যটন স্পটগুলো। সারাবছর পর্যটকের আনাগোনা থাকলেও দুই ঈদ এবং লাগাতার ছুটির সময় দিনে পর্যটকের সংখ্যা কয়েখ লাখ ছাড়িয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও আসেন পর্যটকরা।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির মুখপাত্র বলেন, কক্সবাজারের হোটেল ব্যবসায়ীরা তিল তিল করে একটা পর্যটনবান্ধব পরিবেশ তৈরি করেছেন। রোহিঙ্গাদের জন্য এমনিতেই অনেক সুনামের ক্ষতি হচ্ছে। গণহারে যদি রোহিঙ্গারা সৈকতসহ ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে আসেন, তাহলে এই শিল্প পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।
‘পর্যটকরা সাধারণত যেসব পোশাক পরেন, রোহিঙ্গারা সেগুলো পছন্দ করেন না। তারা টিটকারি মারতে থাকে। আর টাকার জন্য রোহিঙ্গারা চুরি-ছিনতাই, খুন যে কোন অপরাধ করতে পারে। খাদ্যের অভাবে পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়বে রোহিঙ্গা নারীরা। এতে পর্যটনবান্ধব পরিচ্ছন্ন পরিবেশ থাকবে না।’
গত মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেখানে নতুন করে সহিংসতা শুরু হয়েছে। নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ এবং ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার পর দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছেন রোহিঙ্গারা। এর মধ্যে শনিবার (০৯ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ তথ্য দিয়েছে, বাংলাদেশে ইতিমধ্যে তিন লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।
অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই উখিয়া এবং টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে। তবে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে কক্সবাজার শহর এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রবেশ করেছে বলে গণমাধ্যমে তথ্য এসেছে।
বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছার পর শহরে প্রবেশের চেষ্টার প্রমাণ পাওয়া গেছে মেরিন ড্রাইভ রোডে রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে। টমটম গাড়িতে করে তিন নারী, দুই পুরুষ এবং তিনটি শিশু আসছিলেন শহরের দিকে। তবে ইনানি পুলিশ ফাঁড়ির আওতাধীন সোনারপাড়া এলাকায় পুলিশের চেকপোস্টে ধরা পড়ার পর তাদের উখিয়া অস্থায়ী ক্যাম্পের দিকে চলে যেতে দেখা যায়।
টমটমের যাত্রী মিয়ানমারের নাসিদং এলাকার বাসিন্দা আহমদ সৈয়দ বলেন, মা-বাবাসহ তারা মোট ১৪ জন এসেছিলেন। মা-বাবাসহ ৬ জন টেকনাফে একজন আত্মীয়ের বাসায় রয়ে গেছেন। তারা ৮ জন কক্সবাজার শহরে আরেকজন আত্মীয়ের বাসায় যেতে চেয়েছিলেন।
চেকপোস্টে থাকা ইনানি পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই ছোটন চন্দ্র দাশ বলেন, প্রতিদিন অন্তত ৫০-৬০টি শহর অভিমুখী গাড়ি আমরা আটক করছি। অনেক রোহিঙ্গা পরিবার নিয়ে আসছেন। অনেকে একা আসছেন। তাদের আমরা উখিয়ায় অস্থায়ী ক্যাম্পের দিকে চলে যেতে বাধ্য করছি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ বলেন, কিছু কিছু রোহিঙ্গা কক্সবাজার শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছিলাম। এরপর আমরা পুলিশ, আনসার ও জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে চারটি চেকপোস্ট করেছি। গত শুক্রবার থেকে সেভাবে কেউ উখিয়া-টেকনাফের বাইরে আসতে পারছে না।
জানতে চাইলে ট্যুরিস্ট পুলিশের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গারা যদি মূল পর্যটন স্পটগুলোতে আসতে শুরু করেন তাহলে অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও হয়রানি বাড়বে। ট্যুরিস্ট পুলিশের একার পক্ষে তখন পর্যটকদের জন্য সহায়ক পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হবে না। প্রশাসনের সকল পর্যায় থেকে একযোগে কাজ করতে হবে।