গাইবান্ধার সংযুক্ত শরীরে জন্ম নেওয়া শিশু তৌফা ও তহুরাকে দীর্ঘ সাড়ে ৬ ঘণ্টা অস্ত্রোপচারে আলাদা করতে পেরেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিত্সকরা। গতকাল সকাল ৮টা থেকে বিকেল পৌনে ৩টা পর্যন্ত জটিল এই অস্ত্রোপচার শেষে তাদেরকে রাখা হয়েছে পোস্ট অপারেটিভ বিভাগে। শিশু দুটি বর্তমানে সুস্থ ও স্বাভাবিক রয়েছে। তাদের প্রতিটি মুহূর্ত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অস্ত্রোপচার শেষে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. কানিজ হাসিনা শিউলি। তৌফা আর তহুরার অবস্থা স্থিতিশীল জানিয়ে হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহনূর বলেন, ‘বিকেল ৫টার দিকে ওদের সংজ্ঞা ফিরেছে। হাত-পা নেড়ে কেঁদে উঠেছে ওরা।’ এই চিকিত্সক জানান, দুই শিশুর প্রজননতন্ত্র ঠিক করতে আরও কিছু অস্ত্রোপচার করতে হবে পরে। এতদিন মলত্যাগের জন্য কৃত্রিম ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছিল। পায়ুপথ স্বাভাবিক করতে আরও কিছু কাজ করতে হবে। ডা. সাহানুর ইসলাম জানান, একটি বিশেষজ্ঞ টিমের নেতৃত্বে সকাল ৮টার দিকে শিশু দুটির অস্ত্রোপচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের তৃতীয় তলার নিউরো সার্জারি বিভাগের অপারেশন থিয়েটারে এই অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। তিনি আরও বলেন, শিশু দুটির শরীরে অনেক অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাদের প্লাস্টিক সার্জারিও করতে হয়েছে। অপারেশনের প্রতিটি স্তর ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তাদেরকে অচেতন করার ঝুঁকি ছিল। তবে চিকিত্সকদের প্রচেষ্টায় সফলভাবে প্রাথমিক ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে তাদেরকে ২৪ ঘণ্টার পর্যাবেক্ষণে রাখা হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না শিশু দুটিকে বাবা-মায়ের কোলে সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত দেওয়া না যায় ততক্ষণ কোনো স্বস্তি নেই বলে এই চিকিত্সক জানান। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর জোড়া লাগানো শরীর নিয়ে জন্ম হয় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দহবন ইউনিয়নের কৃষক রাজু মিয়া ও তার স্ত্রী শাহিদা বেগমের এই যমজ সন্তানের। তৌফা আর তহুরার পিঠের দিক থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত মেরুদণ্ডের হাড় সংযুক্ত ছিল। মাথা-হাত-পা আলাদা হলেও তাদের মলদ্বার ছিল একটি। শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহনূর ইসলাম জানান, চিকিত্সা বিজ্ঞানের ভাষায় এমন ঘটনাকে ‘পাইগোপেগাস’ বলা হয়। জন্মের আট দিনের মাথায় শিশু দুটিকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসা হলে প্রথমে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাদের মলদ্বার আলাদা করে কৃত্রিম ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রস্তুতির পর মঙ্গলবার সকালে তৌফা ও তহুরাকে আলাদা জীবন দেওয়ার অস্ত্রোপচার শুরু করেন চিকিত্সকরা। বিভিন্ন বিভাগের প্রায় ৩০ জন চিকিত্সক দুটি দলে ভাগ হয়ে দীর্ঘ এই অস্ত্রোপচারে অংশ নেন। অচেতন করাসহ প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষে একদল চিকিত্সক শিশু দুটির দেহ আলাদা করার কাজ শুরু করেন। দুপুরে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আশরাফুল হক কাজল সাংবাদিকদের বলেন, তৌফা ও তহুরার স্পাইনাল কর্ড ও মেরুদণ্ড আলাদা করতে পেরেছেন তারা। দুই শিশুর দেহ আলাদা হওয়ার পর দুপুরে চিকিত্সকদের অন্য দলটি শুরু করেন দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। এই অস্ত্রোপচারকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই সংবাদকর্মীরা অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন দুপুরে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের বলেন, কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে এত বড় অপারেশনের কথা ভাবা যেত না। ‘আপনারা বেশি করে প্রচার করুন। আমাদের চিকিত্সকরা কত বড় অপারেশন করতে পারে, আপনারা দেখান।’ দুই শিশুর বাবা মো. রাজু দুপুরে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তার বিশ্বাস, তাদের দুই শিশু ভালো হয়েই বাড়ি ফিরবে। ‘আমি তো গরিব মানুষ। ক্ষেতে কাজ করি। কারও কোনো ক্ষতি করি না। খোদাও আমাগো দেখবে।’