মঙ্গলবার (২১ মার্চ) সন্ধ্যায় মুসা বিন শমসেরের ব্যবহৃত শুল্ক ফাঁকি দেওয়া কালো রংয়ের রেঞ্জ রোভার গাড়িটি জব্দ করা হয় বলে নিশ্চিত করেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড.মঈনুল খান।
রঙ বদলে চালানোর পরও শুল্ক গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিতে না পেরে গাড়িটি লুকিয়ে ফেলেছিলেন মুসা বিন শমসের; কিন্তু রাখতে পারলেন না।
বিতর্কিত এই ব্যবসায়ীর শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চালানো রেঞ্জ রোভার গাড়িটি নানা নাটকীয়তার পর মঙ্গলবার জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর।
সকাল থেকে অভিযানের পর বিকালে গাড়িটি ধানমণ্ডির একটি বাড়ি থেকে জব্দ করা হয় বলে অধিপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বেয়াই মুসার গুলশানের বাড়িতে এই গাড়িটি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর অভিযানে নামেন শুল্ক গোয়েন্দারা।
অবৈধ গাড়িটি জমা দিতে সকাল ৮টায় নোটিস দেওয়া হয় মুসাকে। তখন তিনি বাড়ি থেকে গাড়িটি সরিয়ে ফেলেছিলেন বলে জানান মইনুল খান।
শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে চলা গাড়ি ধরতে গত বছর অভিযান শুরু করে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ; এর মধ্যেই মুসার গাড়িটির খবর পান গোয়েন্দারা।
শুল্ক গোয়েন্দারা বলেন, গুলশান ২ নম্বর সেকশনের ১০৪ নম্বর রোডের মুসার বাড়িতে গাড়িটি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায় বাড়ির সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে।
কিন্তু সকালে গাড়িটি অন্য স্থানে সরিয়ে ফেলেন তিনি। শুল্ক গোয়েন্দারাও হাল না ছেড়ে গাড়ির পেছন লাগেন।
মইনুল খান বলেন, গাড়িটিতে করে সকালে নাতিকে ধানমণ্ডির স্কুলে পাঠান মুসা। দুপুরে শুল্ক গোয়েন্দারা বাড়িতে অভিযান চালানোর পর গাড়িটি আর বাড়িতে আনা হয়নি। নাতিকে অন্য একটি গাড়িতে করে বাসায় আনা হয়।
শুল্ক গোয়েন্দার দল গাড়ির খোঁজ করতে করতে ধানমণ্ডির ৬ নম্বর সড়কের ৫১/এ নম্বর বাড়িতে রাখা অবস্থায় গাড়িটি পায় বলে মইনুল খান জানান।
ওই বাড়ি থেকে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে গাড়িটি জব্দ করা হয়।
গাড়িটি যখন উদ্ধার করা হয়, তখন এটি ছিল কালো রঙের। তবে নথিপত্র দেখে এর রঙ সাদা ছিল বলে শুল্ক গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন।
যে বাড়ি থেকে গাড়িটি উদ্ধার করা হয়, ধানমণ্ডি ৬ নম্বর সড়কের ৫১/এ বাড়িটি ব্যারিস্টার আখতার ইমামের, যার মেয়ে ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের বড় ছেলে ববি হাজ্জাজের স্ত্রী। আখতার ইমামের ল ফার্মটিতে পরামর্শক হিসেবে ববি হাজ্জাজের নাম রয়েছে।
মুসার আরেক ছেলে জুবি মুসাও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের চেম্বারে কাজ করেন।
শুল্ক গোয়েন্দারা বলেন, ভুয়া আমদানি দলিল দিয়ে গাড়িটির নিবন্ধন করা হয়েছিল।
একজন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, “কাগজপত্র যাচাই করে দেখা যায়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের বিল অব এন্ট্রি ১০৪৫৯১১ তারিখ ১৩/১২/২০১১ এ ১৩০% শুল্ক প্রদান করে ভোলা থেকে রেজিস্ট্রেশন গ্রহণ করা হয়েছে। কাস্টম হাউসের নথি যাচাই করে এই বিল অব এন্ট্রি ভুয়া হিসেবে প্রমাণ পাওয়া গেছে।”
ভোলার বিআরটিএ কার্যালয় থেকে শুল্ক গোয়েন্দাদের জানানো হয়, এই গাড়িটি পাবনার ফারুকুজ্জামান নামে এক ব্যক্তির নামে নিবন্ধন নেওয়া হয়।
গাড়িটি মুসা বিন শমসের ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করেছিলেন বলে প্রমাণ পেয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দারা।
সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ জানায়, গাড়িটির বিষয়ে মুসা বিন শমসেরকে তলব করা হবে এবং তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে মইনুল খান বলেন, “মুসা বিন শমসের বিরুদ্ধে ঢাকা কাস্টমস হাউজে মানি লন্ডারিং এর অভিযোগ এবং শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হবে।”
এই বিষয়ে মুসার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মুসা বিন শমসেরের সম্পদ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত চালাচ্ছে।
১৯৫০ সালের ১৫ অক্টোবর ফরিদপুরে জন্ম নেয়া মুসা ড্যাটকো গ্রুপের মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন। তবে তার পরিচিতি তুলে ধরতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো অস্ত্র ব্যবসার কথাই আগে আনে।
১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যে নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী টনি ব্লেয়ারের নির্বাচনী প্রচারের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আলোচনায় আসেন বাংলাদেশের এই ব্যবসায়ী।
একটি দৈনিকে সুইস ব্যাংকে মুসা বিন শমসেরের ৫১ হাজার কোটি টাকা থাকার খবর ছাপা হয়েছিল। তবে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদের পর গত বছর মুসা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশে বসে কেউ এত অর্থ উপার্জন করতে পারবে না।
মুসার বিরুদ্ধে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করার অভিযোগও রয়েছে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তার বিচারের দাবিও তুলেছেন একাত্তরে স্বজন হারানো সাংবাদিক প্রবীর সিকদার।