গতকাল বুধবার রাত ১১টা ২০ মিনিটে সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি বীরপ্রতীক মারা যান বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা দেবপদ রায়। তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৮০।
শরীরের লবণ কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য বার্ধক্যজনিত কারণে কাঁকন বিবি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। গত ১২ মার্চ রাত সাড়ে ৯টায় অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে দোয়ারাবাজার থেকে সিলেট আনা হয়। পরে তাঁকে হাসপাতালের তৃতীয় তলার ১০ নম্বর কেবিনে ভর্তি করা হয়। ওই রাতে অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। তাঁর চিকিৎসার জন্য ১৫ মার্চ মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়।
কাঁকন বিবির মেয়ে সকিনা জানান, গত বছরের ২১ জুলাই মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হন কাঁকন বিবি। এরপর থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না।
ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক পরিবারে জন্ম কাঁকন বিবির। ১৯৭০ সালে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শহীদ আলীর সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর নাম হয় নুরজাহান বেগম। সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে তিনি থাকতেন।
কাঁকন বিবি তিন দিনের কন্যাসন্তান সকিনাকে রেখে যুদ্ধে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে মুক্তিবাহিনীর হয়ে শুধু গুপ্তচর হিসেবেই কাজ করেননি, করেছেন সম্মুখযুদ্ধও। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়।
কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে স্বামীর সঙ্গে কাকন বিবির প্রথম সংসার ভাঙে। পরবর্তী সময়ে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের সঙ্গে কাঁকন বিবির বিয়ে হয়। মজিদ তখন কর্মসূত্রে সিলেট ইপিআর ক্যাম্পে থাকতেন। দুই মাস সিলেটে স্বামীর সঙ্গে বসবাস করার পর তিনি আগের স্বামীর ঘর থেকে মেয়ে সকিনাকে নিয়ে আসেন। মেয়েকে নিয়ে এসে তিনি স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, স্বামী বদলি হয়ে দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকার কোনো এক ক্যাম্পে আছেন। সীমান্তবর্তী ঝিরাগাঁও গ্রামে জনৈক শহীদ আলীর আশ্রয়ে মেয়েকে রেখে দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা ক্যাম্পে যান তিনি।
১৯৭১ সালের জুন মাস তখন। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন। তাদের বাঙ্কারে দিনের পর দিন অমানুষিকভাবে নির্যাতন সহ্য করতে হয় কাঁকনকে। এরপর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। জুলাই মাসে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী তাঁর সঙ্গে সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকতের দেখা করিয়ে দেন। তাঁর ওপর দায়িত্ব পড়ে গুপ্তচর হিসেবে বিভিন্ন তথ্য জোগাড়ের।
কাঁকন বিবি শুরু করেন পাকিস্তানিদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা। তাঁর সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালিয়ে সফল হন। গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েই দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ফের ধরা পড়েন তিনি। এবার একনাগাড়ে সাত দিন পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তাঁকে বিবস্ত্র করে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লোহার রড গরম করে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছেঁকা দেয়। মৃত ভেবে অজ্ঞান কাঁকন বিবিকে পাকিস্তানি বাহিনী ফেলে রেখে যায়। তাঁকে উদ্ধার করে বালাট সাব-সেক্টরে নিয়ে আসা হয়।
সুস্থ হয়ে তিনি আবার ফিরে আসেন বাংলাবাজারে। অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নেন। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী তাঁকে প্রশিক্ষণ দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সম্মুখযুদ্ধ আর গুপ্তচর উভয় কাজই শুরু করেন। কাঁকন বিবি প্রায় ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।