ঢাকার আশকোনায় র্যাব ক্যাম্পে ‘আত্মঘাতী’ বিস্ফোরণের পর দেশের সব বিমানবন্দর ও কারাগারে সতর্কতা জারি করেছে কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি দেশের নদীবন্দরগুলোতেও নিরাপত্তার জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার বেলা ১টার পর জুমার নামাজের ঠিক আগে আগে ওই বিস্ফোরণে একজন নিহত হন। আত্মঘাতী ওই ব্যক্তি কোনো জঙ্গি দলের সদস্য বলেই প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা।
এর ঘণ্টা দুই পর দেশের বিমাবন্দরগুলোতে বাড়তি সতর্কতা নেওয়ার নির্দেশনা আসে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে।
মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান তুহিন বলেন, “মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সব বিমানবন্দরেই অধিকতর সতর্কতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সহকারী পুলিশ সুপার তারিক আহমেদ জানান, পোশাকে এবং সিভিল ড্রেসে তাদের কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। স্ক্যানিংয়ের জায়গাতেরও লোকবল বেড়েছে।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দুটি প্রবেশ পথে এপিবিএন এর সতর্কতা ও টহলও জোরদার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
দেশের সব কারাগারেও একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক ইকবাল হাসান বলেন, “উত্তরার ঘটনার সব দেশের কারাগারগুলোতে অধিকতর সতর্কতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি ‘রেড অ্যালার্ট’ নয়, তবে সবাইকে ‘অধিকতর সতর্কতা’ অবলম্বন করতে বলা হয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির বলেন, “আমরা সব সময়ই সতর্ক। যেহেতু একটি ঘটনা ঘটেছে, তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে নির্দেশ দিয়েছেন।”কারা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে মোট ৬৮ কারাগারে ৭০ হাজারের বেশি বন্দি রয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারেই আড়াইশর বেশি জঙ্গি সদস্যকে রাখা হয়েছে।
কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের সুপার মো. মিজানুর রহমান আমাদের গাজীপুর প্রতিনিধিকে বলেন, “আমরা এমনিতেই সতর্ক। তারপরও সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে।”
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক জানান, তারা ফটকে নিরাপত্তা তল্লাশি জোরদারের পাশাপাশি কারারক্ষীর সংখ্যা ও টহল বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। পাশাপাশি দুর্ধর্ষ বন্দিদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ এর সুপার সুব্রত কুমার বালা।
গত ৬ মার্চ বিকেলে জঙ্গি দল হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীদের আদালত থেকে কাশিমপুর কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়ার পথে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়।
গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সুলাইমান বলেন, “আশকোনায় আত্মঘাতি বোমা হামলার পর গাজীপুরের পুলিশ সতর্ক রয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তল্লাশি বাড়ানো হয়েছে।”
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) জনসংযোগ কর্মকর্তা মোবারক হোসেন মজুমদার বলেন, তারাও নদী বন্দরগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা নেওয়ার নির্দেশনা পেয়েছেন।
তিনি জানান, সারাদেশে ২৭টি নদী বন্দর রয়েছে। তার মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনা ও আরিচা বন্দর দিয়ে বেশি যাত্রী যাতায়াত করেন।
২০১৫ সালের শুরু থেকে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সময়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখক, ব্লগার, প্রকাশকরা। তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যা এবং চট্টগ্রামের নৌ বাহিনীর মসজিদে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাও সে সময় ঘটে।
গতবছর জুলাই মাসে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও শোলাকিয়ায় ঈদের দিন জঙ্গি হামলার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মধ্যে বেশ কিছুদিন পরিস্থিতি শান্ত থাকে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, জঙ্গিদের অনেকটাই দুর্বল করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু গত ৭ মার্চ কুমিল্লায় একটি বাসে তল্লাশির সময় দুই জঙ্গি পুলিশের দিকে বোমা ছুড়লে তাদের তৎপরতা বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। তাদের মধ্যে একজনকে সঙ্গে নিয়ে ওই রাতেই মিরসরাইয়ের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও বোমা উদ্ধার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।
এরপর গত বুধবার বিকালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এক বাড়ি থেকে বিস্ফোরকসহ এক জঙ্গি দম্পতিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাশের ওয়ার্ডে আরেক বাড়িতে দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টা অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও সোয়াট।
আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ও গুলিতে এক নারীসহ চার জঙ্গি নিহত হওয়ার মধ্যে দিয়ে সীতাকুণ্ড অভিযানের সমাপ্তি ঘটে। নিহত নারী জঙ্গির পাশে পরে এক শিশুর বোমায় বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, সীতাকুণ্ডের ঘটনার প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার দুপুরেই সর্তকতা ও তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে বিভিন্ন রেঞ্জের ডিআইজি, র্যাব, এসবি, সিআইডি, পিবিআইসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর প্রধানদের দুটি চিঠি পাঠানো হয়।
এর মধ্যে একটি চিঠিতে মসজিদ, মন্দির, গীর্জাসহ বিভিন্ন উপসনালয়, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ স্পর্শকাতর জায়গায় নজরদারি ও সতর্কতা বাড়ানোর নির্দেশনা ছিল। আর অন্যটিতে জঙ্গিদের ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানোর বিষয়ে বলা হয়।