নতুন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা চারজনের সঙ্গে দুই অধ্যাপকের সহায়তা নিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির কাছে নাম প্রস্তাবকারী এই সার্চ কমিটির প্রধান করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে। বর্তমান ইসি গঠনে গতবারও একই দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
গতবারের মতো এবারও সার্চ কমিটিতে হাই কোর্ট বিভাগের একজন বিচারক থাকছেন। এবার এই দায়িত্ব পেলেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
গতবারের মতোই সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ও কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) পদধারী ব্যক্তিরা থাকছেন এই কমিটিতে। তারা হলেন পিএসসির এবারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক এবং সিএজি মাসুদ আহমেদ।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিরীণ আখতারকে সার্চ কমিটিতে নেওয়া হয়েছে।
আপিল বিভাগের বিচারপতি মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে গতবার সার্চ কমিটিতে ছিলেন হাই কোর্টের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান, পিএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যান এ টি আহমেদুল হক চৌধুরী ও তৎকালীন সিএজি আতাউল হাকিম।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান চারজনের সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন; এবার সদস্য সংখ্যা দুজন বাড়িয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে এতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন আবদুল হামিদ।
প্রয়াত জিল্লুর রহমানের মতোই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মাসব্যাপী সংলাপের পর বুধবার সার্চ কমিটি গঠন করেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
সকালে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠনের বিষয়ে চিঠি পাওয়ার পর সার-সংক্ষেপ তৈরি করে তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
সেখান থেকে ফাইল ফেরত আসার পর সন্ধ্যায় ছয় সদস্যের সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটির প্রজ্ঞাপন জারি হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে। নবগঠিত সার্চ কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে এই দপ্তর।
প্রজ্ঞাপন জারির পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবদুল ওয়াদুদ সাংবাদিকদের বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে ইসি গঠনের লক্ষ্যে এই সার্চ কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।”
এ্ই সার্চ কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে একজন নারীও নিয়োগ পাবেন জানিয়ে সেই অনুযায়ী সুপারিশ করতে বলা হয়েছে সার্চ কমিটিকে।
সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সবার নাম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হয়।
সৈয়দ মাহমুদ হোসেন: ছয় বছর ধরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। ১৯৮১ সালে জেলা আদালতের আইনজীবী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। হাই কোর্টে আসেন তার দুই বছর পর। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করে ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাই কোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। এর দুই বছর পর হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি হওয়া মাহমুদ হোসেন আপিল বিভাগে উন্নীত হন ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি।
ওবায়দুল হাসান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং আইন বিভাগ থেকে এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে ওবায়দুল হাসান জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৯৮৬ সালের মার্চে। তার দুই বছর পর হাই কোর্ট বিভাগে এবং ২০০৫ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। ২০০৯ সালের জুনে হাই কোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে নিয়োগ পান। ২০১১ সালের জুনে স্থায়ী হন সেখানে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকের দায়িত্বে আসেন। পরে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ট্রাইব্যুনাল-২ এর কার্যক্রম বন্ধ হলে হাই কোর্ট বিভাগে ফিরে যান তিনি।
মোহাম্মদ সাদিক: ১৯৮২ সালের নিয়মিত বিসিএস ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ সাদিক নির্বাচন কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকার সময় ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর পিএসসি সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। গত বছরের ২৫ এপ্রিল পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ১৯৫৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে জন্ম নেওয়া সাদিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি নিয়ে যুক্তরাজ্যে উচ্চ শিক্ষা নেন। পরে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সিলেটিনাগরী লিপির উপর গবেষণার জন্যে ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। আমলাদের মধ্যে কবি হিসেবে পরিচিত সাদিক বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে সক্রিয় রয়েছে। তিনি বাংলা একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ-এর জীবন-সদস্য। জাতীয় কবিতা পরিষদ ও বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি।
মাসুদ আহমেদ: ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পান মাসুদ আহমেদ। ’৮১ ব্যাচের এ কর্মকর্তা হিসাব ও নিরীক্ষা ক্যাডারে সরকারি চাকরি শুরু করেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। সরকারি কর্মকর্তা মাসুদ আহমেদও লেখালেখি করেন। তার প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা ১০০টি, এছাড়া সাতটি উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। তার লেখা নিয়ে তৈরি আটটি টেলিফিল্ম বিভিন্ন টেলিভিশনে সম্প্রচার হয়েছে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অধ্যাপনার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সমানভাবে লিখে যাচ্ছেন। বাংলা একাডেমি, কাগজ সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য তিনি। সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা সৈয়দ মনজুরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন ১৯৭২ সালে। এর দুই বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন তিনি। ১৯৮১ সালে কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি নেন।
শিরীণ আখতার: বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শিরীণ আখতার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নারী উপ-উপাচার্য হিসেবে গত বছরের ২৮ মার্চ কাজ শুরু করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির অষ্টম উপ-উপাচার্য। ১৯৮৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া শিরীণ আখতার ১৯৯৬ সালের ১ জানুয়ারি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিইএচডি ডিগ্রি নেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে চট্টগ্রামের এনায়েত বাজার মহিলা কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি।
সার্চ কমিটির কাজ যেভাবে
সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির কাজ সহজ করতে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য কয়েকটি নাম প্রস্তাব করবে।
তার মধ্য থেকে অনধিক পাঁচজনকে নির্বাচন পরিচালনাকারী সাংবিধানিক সংস্থার দায়িত্বভার অর্পণ করবেন রাষ্ট্রপ্রধান। এর মধ্যে একজন হবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার, বাকিরা নির্বাচন কমিশনার।
এবার তিন সদস্যের উপস্থিতিতে কমিটির কোরাম গঠিত হবে; সভায় উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রস্তাব চূড়ান্ত করবে তারা। সিদ্ধান্তের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিজেদের প্রস্তাব চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে তা পাঠায় সার্চ কমিটি। রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিলুপ্তি ঘটে এই কমিটির।
কাজী রকিব নেতৃত্বাধীন আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগেই বিদায় নিচ্ছেন। তারপরই দায়িত্ব নেবে নতুন ইসি, যার জন্য গঠিত হয়েছে সার্চ কমিটি।