টানা বৃষ্টি ও বন্যায় দেশের অনেক মহাসড়কের বেহাল অবস্থা। দূরপাল্লার বাসে গন্তব্যে পৌঁছতে আগের তুলনায় বর্তমানে দুই-তিনগুণ সময় বেশি লাগছে। ঈদের আগে এ সময় আরও বাড়তে পারে এমন আশঙ্কায় অনেকে এবার ট্রেনে বাড়ি যাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল; কিন্তু সে আশায়ও গুড়ে বালি। কারণ বন্যায় বেশ কয়েকটি জেলার রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এবারের ঈদযাত্রায় বড্ড কষ্ট ও দুর্ভোগ পোহাতে হবে এমন আশঙ্কা সাধারণ মানুষের।
ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ঈদুল আজহার আগের দিনগুলোতে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে সড়কপথে ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক নাও হতে পারে। তিনি বলেছেন, সড়ক-মহাসড়ক যান চলাচলের উপযোগী রাখতে দিন-রাত কাজ চলছে। বৃষ্টি না হলে ঈদের আগেই ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো যানবাহন চলাচলের উপযোগী করা সম্ভব হবে।
একইভাবে ঈদের আগেই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন মেরামতের আশ্বাস দিয়েছেন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। টানা বৃষ্টি ও বন্যায় উত্তরাঞ্চলের সড়কের অবস্থা এখন এতটাই বিপর্যস্ত যে, বিকল হওয়ার ভয়ে দামি বাস পথে নামাচ্ছে না মালিকরা। অন্যবার ঈদের সময় দূরপাল্লার বাসে ট্রিপ বাড়ানো হলেও এবার অর্ধেকেরও বেশি ট্রিপ কমানো হয়েছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি সড়কের অবস্থা ভালো হয় তাহলে ট্রিপের সংখ্যা বাড়াবেন তারা। আর কয়েক দিন পরই বিভিন্ন স্থান থেকে গরুবাহী ট্রাক আসা শুরু হবে, তখন পরিস্থিতি আগের তুলনায় আরও খারাপ হতে পারে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় অবশ্য আগামী ২৬ আগস্টের মধ্যে মহাসড়কের সংস্কার কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে। এর আগে গত ৯ আগস্ট সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সড়ক ও জনপথের যত রাস্তা খারাপ অবস্থায় রয়েছে তা সংস্কার করতে সাত-দশ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। গত শনিবার মন্ত্রীর বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন মহাসড়কেই এখন মেরামত কাজ চলছে। তবে কিছু এলাকার সংস্কার কাজে অনিয়মেরও অভিযোগ উঠেছে।
বৃষ্টি ও বন্যায় সড়ক-মহাসড়কের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল বাশার গতকাল সকালের খবরকে জানান, সব জায়গার পুরো তথ্য এখনও আমাদের হাতে এসে পৌঁছেনি। আশা করছি আগামী দু’তিন দিনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে। তবে সড়ক বিভাগের একটি সূত্র জানায়, বৃষ্টি-বন্যায় কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সব প্রধান মহাসড়ক। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের ২৩টি পয়েন্টে এক থেকে তিন কিলোমিটার এখনও পানির নিচে ডুবে রয়েছে। এছাড়া বন্যার পানির প্রবল তোড়ে ভেসে গেছে উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের ১৮টি স্থান। অন্তত ৩ হাজার কিলোমিটার রাস্তা এবং শতাধিক ব্রিজ ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবারের বন্যায়। শুধু রংপুর বিভাগেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৭২ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কুড়িগ্রামের। ঈদের আগে এই জেলার সঙ্গে যোগাযোগ আদৌ স্বাভাবিক হবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের হাটিকুমরুল-বগুড়া অংশে ইট ফেলে সৃষ্ট গর্ত ভরাট করা হয়েছে। গাড়ি চলাচলে ইট উঠে আবারও গর্ত সৃষ্টি হচ্ছে। হাটিকুমরুল থেকে উল্লাপাড়া পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তে ঢাকা-এলেঙ্গা মহাসড়কের দশাও বেহাল। হাটিকুমরুল থেকে বগুড়া এবং পলাশবাড়ী থেকে মোকামতলা পর্যন্ত পুরো মহাসড়ক খানাখন্দে ভরা। টাঙ্গাইল শহর থেকে কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা বেশ শোচনীয়। অনেক স্থানে বিটুমিনের চিহ্ন নেই। ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের সিরাজগঞ্জের নলকা সেতুর ওপর বিটুমিন কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ হলেও সেতুর পশ্চিম পাড় থেকে হাটিকুমরুল গোলচত্বরের ২০০ মিটার আগে পর্যন্ত অসংখ্য খানাখন্দ। টানা বৃষ্টিতে দেশের প্রায় সবগুলো মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে।
ভাঙাচোরার কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঘোড়াশাল অংশ পার হতে তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগছে। এ মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের কারণে সেখানেও দীর্ঘ যানজট হচ্ছে।
ভালো নয় ঢাকা-বরিশাল এবং ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের অবস্থাও। দৌলতদিয়া ঘাট থেকে রাজবাড়ীর বসন্তপুর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার এবং রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের ৪৯ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ।
গাজীপুরের জয়দেবপুরের ভোগড়া থেকে চন্দ্রা হয়ে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। ফলে সেখানেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের টঙ্গী সেতু থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত বেহাল দশা সৃষ্টি হয়েছে। সড়কের কোথাও কোথাও চলার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
পদ্মায় পানি বৃদ্ধি আর তীব্র স্রোতের কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ফেরি পারাপারে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ সময় বেশি লাগছে। দৌলতদিয়া ঘাটের কাছে পদ্মার তীব্র স্রোতে হুমকির মুখে রয়েছে দৌলতদিয়ার সবক’টি ফেরিঘাট। পাশাপাশি ফেরি কমে যাওয়ায় গত দু’সপ্তাহ ধরে দৌলতদিয়ায় যানজট নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ফেরির ট্রিপ আগের তুলনায় অনেক কমেছে। আগে যেখানে প্রতিদিন ১৭০-১৮০টি ট্রিপ হতো বর্তমানে সেখানে ১৩০-১৩৫টি ট্রিপ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
রেলপথ : বন্যায় রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গতকাল সকাল থেকে ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া বন্যার পানিতে রংপুরের কাউনিয়া-তিস্তা-মহেন্দ্রনগর পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার রেলপথের ২০টি স্থানে স্লিপার ভেসে গিয়ে সেখানে ১৫-৩০ ফুট গর্ত হয়েছে। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় ১২০ ফুট রেলপথ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। কুড়িগ্রাম জেলায় ভেঙে গেছে রেলের দুটি ব্রিজ।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থেকে মন্মথপুর পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার রেলপথের ৪৮টি স্থানে স্লিপার সরে গিয়ে রেললাইনের নিচে বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। দিনাজপুর জেলায় ৫০ ফুট জায়গায় ৫ ফুট গর্ত হয়েছে। এই জেলার কাঞ্চন থেকে বাজনাহার পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার রেলপথের স্লিপার সরে গিয়ে গভীর গর্ত হয়েছে। কাঞ্চন থেকে বিরল পর্যন্ত এক কিলোমিটার রেলপথ ১২ ফুট গর্তে বিলীন হয়েছে। দিনাজপুর সদরের কাউগাঁ এলাকার এক কিলোমিটার রেললাইন পানির নিচে। সব মিলিয়ে রংপুর বিভাগের প্রায় ১০০ কিলোমিটার রেলপথ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঈদুল আজহার আগের দিনগুলোতে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে সড়কপথে ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করা চ্যালেঞ্জ হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হবে। প্রকৌশলীরা রাস্তাগুলো চলাচল উপযোগী করতে ২৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। গতকাল মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সারাদেশে বন্যায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষয়ক্ষতি এবং ঈদ প্রস্তুতি নিয়ে এক জরুরি সভা শেষে প্রেসব্রিফিংয়ে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, দিনাজপুর থেকে গোবিন্দগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তাটি পানিতে ধুয়ে গেছে। এবারকার অতি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ভয়াবহতা এত তীব্র ছিল যে এ পর্যন্ত ২৩টি পেয়েন্টে এক থেকে তিন কিলোমিটার রাস্তা পানির নিচে ডুবে রয়েছে এবং উত্তরাঞ্চলসহ ১৮টি পয়েন্টে বেশ কিছুদূর এলাকা ভেসে গেছে। পানিতে ডুবে থাকা পয়েন্টগুলো এমুহূর্তে সংস্কার করা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। মন্ত্রী বলেন, এবারের বন্যা অতীতের সব রেকর্ড ভাঙতে চলেছে। এর ভয়াবহতা ব্যাপক। অনেক ব্রিজ-কালভার্ট নষ্ট হয়ে গেছে। এই ক্ষয়ক্ষতি ঈদের আগে পরিপূর্ণভাবে ঠিক করা চ্যালেঞ্জ, তবে আমরা চেষ্টা করছি। যদি বৃষ্টি-বাদল না হয় আমরা আশা করছি ঈদের আগে রাস্তাগুলো ব্যবহারযোগ্য করা যাবে। বিটুমিনাস কাজ সম্পূর্ণ করতে পারব, এটা আমি বলতে পারছি না। তবে বৃষ্টি-বাদল যদি অব্যাহত থাকে তাহলে এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করা খুবই চ্যালেঞ্জ হবে। অন্যান্য বছরের মতো এবার পোশাক কারখানায় পর্যায়ক্রমে ছুটি দিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সড়ক ও মহাসড়কের ওপর পশুর হাট বসানোর ব্যাপারে আমাদের পরিষ্কার নির্দেশনা, কোনো পশুর হাট বসানো যাবে না। সবচেয়ে বড় পশুর হাট ভাঙ্গার মালিগ্রামে পশুর হাট বসানো হবে না বলে আমরা নিশ্চয়তা পেয়েছি।
পৌরসভা, সিটি করপোরেশন সবাই আমাকে আশ্বস্ত করেছে মহাসড়কে তারা পশুর হাট বসাবে না।’ ফিটনেসবিহীন গাড়িতে কোরবানির পশু বহন করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঈদের আগে পাঁচ দিন ও ঈদের পর পাঁচ দিন সিএনজি স্টেশন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। ঈদের আগের তিন দিন মহাসড়কে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লরি চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য-দ্রব্য, পচনশীল দ্রব্য, গার্মেন্টস সামগ্রী, ওষুধ বহনকারী যানবাহনে এর আওতামুক্ত থাকবে। বাড়তি ভাড়া বন্ধে বাস টার্মিনালে ভিজিল্যান্স টিম থাকবে জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, ২৫টি পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে যানজট নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা এবারও রয়েছে। ১৫টি পয়েন্টে আইপি ক্যামেরা থাকবে। মেঘনা ও গোমতী সেতুতে চারটি বাড়টি টোল বুথ থাকবে। ট্রাকের জন্য আলাদা বুথ থাকবে। মদনপুর ও কাচপুরে আলাদা লেন করা হচ্ছে। সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন-সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান মো. মশিয়ার রহমান, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আহম্মদ প্রমুখ।