হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মূল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুটি তদন্ত দল ঘটনাস্থল পরির্দশন করেছেন।এয়ার ইন্ডিয়া থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিভিল এভিয়েশন। শনিবার (১২ আগস্ট) তারা পরির্দশন করেন। এর আগে শুক্রবার (১১ আগস্ট) হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মূল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে পুড়ে গেছে এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসকক্ষ। ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিটের সদস্যরা প্রায় দেড় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় ২৭টি ফ্লাইটের যাত্রা বিলম্বিত হয় বলে বিমানবন্দর সূত্র জানায়। এ সময় হজযাত্রীসহ সহস্রাধিক যাত্রী চরম ভোগান্তিতে পড়ে। আগুন আতঙ্কে দেশি-বিদেশিসহ যাত্রী ও যাত্রীর স্বজন এবং ভেতরে থাকা বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বহির্গমন বিভাগ ও বিমান উড্ডয়ন সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। বিমান অবতরণ হলেও দেশে ফিরে যাত্রী ও তাদের স্বজনরা ভোগান্তিতে পড়ে। দুপুর ১টা ৩৭ মিনিটে বিমানবন্দরের মূল ভবনের তৃতীয় তলায় টার্মিনাল-২ এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে আগুনের সূত্রপাত হয়। বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয় বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়। ততক্ষণে আগুনে এয়ার ইন্ডিয়ার পার্শ্ববর্তী কাতার এয়ারওয়েজ, সৌদি আরাবিয়া এয়ারলাইন্স, চতুর্থ তলার ইতিহাদ এয়ারওয়েজ ও তুর্কি এয়ারওয়েজ কার্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তদন্তে ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সরেজমিন জানা গেছে, দুপুর ১টা ৩৭ মিনিটে ধোঁয়া এবং ফায়ার অ্যালার্মের মাধ্যমেই বিমানবন্দরে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা আগুনের বিষয়টি আঁচ করতে পারেন। তৃতীয় তলায় এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে আগুন লাগার বিষয়টি মুহূর্তেই বিমানবন্দরের সব ইউনিট অবগত হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই বিমানবন্দরের অভ্যন্তর ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে ছুটে যায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তারক্ষীসহ ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। বিমানবন্দরে থাকা যাত্রী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের উদ্বিগ্ন না হতে অনুরোধ করলেও তাদের সবারই চোখে-মুখে ছিল উত্কণ্ঠার ছাপ। ঘটনাস্থলে থাকা একাধিক ব্যক্তি জানায়, অগ্নিকাণ্ডের সময় এয়ার ইন্ডিয়ার কার্যালয় তালাবদ্ধ ছিল। এ সময় ধোঁয়ায় তৃতীয় ও চতুর্থ তলা অন্ধকার হয়ে যায়। ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সৌদি এয়ারলাইন্স ও কাতার এয়ারওয়েজের অফিসের কিছু অংশে। এয়ার ইন্ডিয়ার ঠিক ওপরে চতুর্থ তলায় থাকা ইতিহাদ এয়ারওয়েজের অফিসের ফ্লোরের টাইলস আগুনের তাপে উঠে আসে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসের তালা ভেঙে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে যায় এয়ার ইন্ডিয়ার অফিস। অন্যদিকে সূত্র জানায়, গতকাল দুপুর দেড়টার পর থেকে দেশি ও বিদেশি এয়ারলাইন্সের মোট ২৭টি ফ্লাইট ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও গত রাত পৌনে ৯টা পর্যন্ত কোনো ফ্লাইট ছেড়ে যেতে পারেনি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিমানবন্দরের বিদ্যুত্ সংযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোনো এয়ারলাইন্স যাত্রীদের চেকইন করাতে পারেনি। বিকেল ৪টা থেকে শুরু হয় চেকইন। এর আগে গ্রিন সিগন্যাল না পেয়ে সৌদি এয়ারলাইন্স, মালিন্দ এয়ার এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চারটি ফ্লাইট আধ ঘণ্টারও বেশি সময় আকাশে ঘুরে অবতরণ করে। এর মধ্যে বিকেলে রিয়াদ থেকে ছেড়ে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট অতিরিক্ত ৩০ মিনিট আকাশে ঘোরার পর অবশেষে অবতরণ করে বিকেল ৪টায়। বিমান বাংলাদেশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গত রাতে বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিমানের আরও আটটি ফ্লাইট ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। আটটি ফ্লাইটের মধ্যে সন্ধ্যা ৬টায় ছিল আবুধাবির ফ্লাইট। রাত ৭টা ৫৫ মিনিটে ছিল হজ ফ্লাইট। এখন পর্যন্ত আমরা তিনটি ফ্লাইটের শিডিউল পেয়েছি। এয়ার ইন্ডিয়ার স্টেশন ম্যানেজার রাজেন্দ্র কলি বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সময় আমাদের অফিস তালাবদ্ধ ছিল। সেখানে তখন কারও থাকার কথাও নয়। সাধারণত বিকেল ৩টার আগে-পরে আমাদের স্টাফরা অফিসে আসেন। রাতের ফ্লাইটের প্রস্তুতি নেন। রাত ৮টা ২৫ মিনিটের দিকে অ্যারাইভাল হয় এবং রাত ৯টা ৩০ মিনিটের দিকে ডিপারচার হয়। আগুন কীভাবে লাগল এ বিষয়ে আমরা কোনো ধারণাই করতে পারছি না। ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি : ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন্স) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ জানান, শাহজালাল বিমানবন্দরের মূল ভবনের তৃতীয় তলায় আগুনের ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন-ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ঢাকা) দেবাশীষ বর্ধন, সহকারী পরিচালক (ঢাকা) মামুন মাহমুদ ও কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আবদুল মান্নান। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। যাত্রীরা যা বললেন : ষাটোর্ধ্ব আলী আহমেদ নামে এক হজযাত্রী জানান, তাদের বাড়ি ঢাকার কেরানীগঞ্জে। বিমানবন্দরের ভেতরেই জুমার নামাজের জন্য তারা দুই শতাধিক যাত্রী প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় হঠাত্ ‘আগুন আগুন’ বলে চিত্কার শুনতে পান। সেখানকার কর্মকর্তারা হজযাত্রীদের তাদের মালামালসহ দ্রুত বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তারা বাইরে এসে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। বিকেল ৫টায় ফ্লাইট তাদের। যথাসময়ে তারা হজে যেতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। এয়ার এমিরেটের যাত্রী সারগিই জানান, তিনি রাশিয়া থেকে এসেছেন। বাংলাদেশে তিনি ব্যবসায়িক কাজে চট্টগ্রাম হয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরে আসেন। দুপুরে আগুনের ঘটনা ঘটার পর তিনি আতঙ্কে বাইরে চলে আসেন। সৌদি এয়ারলাইন্সের যাত্রী হুমায়ুন কবির বলেন, বিকেল সোয়া ৫টায় আমার ফ্লাইট ছিল। এ জন্য ১টার দিকে শাহজালাল বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশ করি। মালামাল বুকিং দেই। দেড়টার পর আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুনের ধোঁয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে ১টা ৪১ মিনিটে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে বের হয়ে আসি। ভেতরে প্রবেশের জন্য মাইকিং করা হলে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আমি আবার ভেতরে প্রবেশ করি। সোয়া ৫টায় ওই যাত্রী জানান, ইমিগ্রেশনে তখনও বিদ্যুত্ আসেনি। শর্টসার্কিটেই আগুন : এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের (এএপি) এএসপি আফতাব উদ্দিন জানান, বিমানবন্দর টার্মিনাল ভবনের তৃতীয় তলায় এয়ার ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্সের অফিস থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে আমাদের ধারণা। আগুনের সময় ওই অফিসে কেউ ছিলেন না। সংশ্লিষ্টরা ওই অফিসের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে আগুনের চেয়ে ধোঁয়ার উপস্থিতি বেশি ছিল। ফ্লাইট বাতিল হয়নি : অন্যদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক কাজী ইকবাল করিম জানান, বিমানবন্দরে আগুন লাগার পর যাত্রীদের ভেতর থেকে বের করে দেওয়া হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও টার্মিনালের ভেতরে ধোঁয়া ছিল। ফলে যাত্রীদের ভেতরে প্রবেশে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে কোনো ফ্লাইট বাতিল হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত যেসব অফিস : এয়ার ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্সের অফিসে আগুন লাগার পর বিস্ফোরণের বিকট শব্দ হয়। এতে ওই অফিসের গ্লাস ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। এয়ার ইন্ডিয়া অফিসের পাশে সৌদি এয়ারলাইন্স ও কাতার এয়ারলাইন্সের অফিস ছিল। আগুনে সেসব অফিসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া এয়ার ইন্ডিয়া অফিসের ওপরে ইত্তিহাদ ও তুর্কি এয়ারলাইন্সের অফিস ছিল। ওই অফিসের টাইলস ছিন্নভিন্ন হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি সূত্র জানায়, চতুর্থ তলায় দুটি এয়ারলাইন্স ছাড়াও আরও কয়েকটি এয়ারলাইন্সের অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিকেলেও ছিল ধোঁয়া। সেখানে ফায়ারসার্ভিসের সদস্যরা কাজ করছিলেন।