দেশের শ্রমশক্তি রফতানির অন্যতম প্রধান বাজার মালয়েশিয়া। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে বর্তমানে প্রায় আট লাখ বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছে বিভিন্ন খাতে। কিন্তু এর মধ্যে প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছে অবৈধ। এসব অবৈধ শ্রমিক প্রথমে সাময়িক ওয়ার্ক অর্ডার নিয়ে কাজ শুরু করলেও পরে দেশটির সরকার তাদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দেয়। অবৈধ শ্রমিকদের বৈধতা নিশ্চিতের জন্য মালয়েশিয়া সরকার ই-কার্ড নিবন্ধনের কার্যক্রম শুরু করেছিল গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এবং শেষ সময় ছিল গত ৩০ জুন। কিন্তু দালালদের চক্রান্তে এবং নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতার কারণে অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিকরা বৈধ হতে পারেনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে। ফলে গত দুই সপ্তাহে সহস্রাধিক বাংলাদেশি শ্রমিক সে দেশের ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেল খাটছে। এজন্য মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তাদের গাফিলাতিকেও দায়ী করছেন অনেকে। মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ করতে গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘রি-হায়ারিং’ পদ্ধতি চালু করে। রি-হায়ারিংয়ে প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক আবেদন করলেও ভিসা পায় মাত্র ১৮ হাজার শ্রমিক। এই রি-হায়ারিং শেষ হওয়ার আগেই মালয়েশিয়া সরকার আবার এনফোর্সমেন্ট কার্ড বা ই-কার্ড চালু করে। তবে ই-কার্ডে নিবন্ধনের চার মাসের সুযোগ থাকলেও এতে তেমন সাড়া দেয়নি বাংলাদেশি শ্রমিকরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ই-কার্ডের মাধ্যমে বৈধ হওয়ার সুযোগের পর মাত্র ৭২ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি বৈধতার আবেদন করেছে। অথচ মালয়েশিয়ায় তিন লাখ অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছে। তাহলে বৈধ হওয়ার এমন সুযোগ পাওয়ার পরও কেন বৈধ হচ্ছে না বাংলাদেশিরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখানেও রয়েছে দালালদের চক্রান্ত। মূলত দালাল চক্র এবং নিয়োগকারীদের অনীহার কারণেই বঞ্চিত হয়েছে তারা। নিয়মানুযায়ী, নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিককে সশরীরে ইমিগ্রেশনে হাজির হয়ে যাবতীয় তথ্য দিতে হয়। সেক্ষেত্রে অনেক নিয়োগকারী তাদের শ্রমিককে এই সুযোগ দেয়নি। ‘সময় বাড়ানো হবে’-নিয়োগকারীর এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে অনেকেই ই-কার্ড নিবন্ধনের আবেদন করেনি। আবার না বুঝে অনেকেই দ্বারস্থ হয়েছে দালালের। ফলে দালালদের প্রতারণায় ই-কার্ডের সুযোগ বঞ্চিত হয়েছে শ্রমিকরা। অথচ মালয়েশিয়া সরকার বিনামূল্যেই ই-কার্ড নিবন্ধন করার সুযোগ দিয়েছিল। অবৈধভাবে যেসব শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যায় তারা সেখানে কাজ করলেও দালালদের নিয়ন্ত্রণেই থাকে। তাছাড়া তাদের বেতনও চলে যায় দালালদের হাতে। এ কারণে অবৈধ শ্রমিকরা সাধারণত কর্মস্থলের বাইরে খুব একটা যায় না। দালালরাও বাধা দেয় তাদের বাইরে যেতে। এ কারণে মালয়েশিয়া সরকার বৈধতা দেওয়ার জন্য ‘রি-হায়ারিং’ পদ্ধতি চালু করার পরও অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক যেতে পারেনি। আর এসব শ্রমিকই এখন পড়েছে চরম বিপাকে। অবশ্য কেবল দালালই নয় বাংলাদেশি অবৈধ শ্রমিকদের ভোগান্তির জন্য মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের গাফিলতিও দায়ী। জনশক্তি রফতানিকারকরা বলেন, হাইকমিশনের লেবার কাউন্সিল বিভাগের অদক্ষতার কারণে অবৈধ শ্রমিকরা বৈধ হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তারা যদি সত্যিকারের ‘ক্যাম্পেইন’ করত তাহলে আরও অনেক অবৈধ শ্রমিক বৈধ হতে পারত। হাইকমিশনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের ব্যাপারে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা উচিত বলে মনে করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা। মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সিলর সায়েদুল ইসলাম এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে জানান, ই-কার্ডের জন্য হাইকমিশনের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং লিফলেটে প্রচার করা হয়েছিল, কিন্তু অনেকেই করছি করছি বলে বাদ পড়ে গেছে। কেউ কেউ আবার দালালদের খপ্পরে পড়ে ই-কার্ড করতে পারেনি। তবে খুব বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের বৈধ হওয়ার সময় বাড়ানের চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। আবার বিপুলসংখ্যক বিদেশি অবৈধ শ্রমিক গ্রেফতারের শিকার হওয়ায় নিয়োগ কর্তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বহীনতার অভিযোগ এনেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়া ও মালয়েশিয়ার মানবাধিকার সংগঠন তানাগানিতা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়ার সভাপতি আখবার সাতার সে দেশের গণমাধ্যমকে বলেন, অভিবাসন আইন অনুযায়ী, অবৈধ অভিবাসনের দায়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন নিয়োগকর্তাদের ১০ হাজার রিঙ্গিত জরিমানা ও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড যথেষ্ট নয়। আখবার সাতারের মতে, যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সে জন্য শ্রমিকদের বেশি দুর্ভোগ পোহানোটা রীতিমতো অন্যায়। কারণ এ ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাদেরও দায় আছে। নিজেদের শ্রমিকদের নিবন্ধন করানোর জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়ার পরও সুযোগটা এসব নিয়োগকর্তা নষ্ট করেছেন। বিদেশি শ্রমিক নিয়োগের সময় কেন মধ্যস্বত্বভোগীদের ব্যবহার করা হয়, সেটি অভিবাসন দফতরের খতিয়ে দেখা উচিত। মালয়েশিয়া সরকার কেবল অবৈধ শ্রমিকদের গ্রেফতার করছে তা নয়, দালাল চক্রকেও ধরতে অভিযান চালাচ্ছে দেশটির ইমিগ্রেশন পুলিশ। গ্রেফতার দেড় হাজার : গত ৩০ জুন মধ্যরাত থেকে অবৈধ শ্রমিক গ্রেফতারে অভিযান চালায় মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ। গতকাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশি অবৈধ শ্রমিক গ্রেফতার হয়েছে প্রায় দেড় হাজার। তাছাড়া গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের মোট ২ হাজার ৬৩০ জন অবৈধ অভিবাসী ক্র্যাকডাউন অভিযানে আটক হয়েছে। তার মধ্যে ৫৮০ জন মহিলা এবং ১৫ জন শিশু রয়েছে। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার ৬৯৫, মিয়ানমারের ২৩১, ভিয়েতনামের ১১৬, থাইল্যান্ডের ১১১ ও ফিলিপাইনের ৯৫ জন অবৈধ শ্রমিক রয়েছে বলে জানা যায়। কী ঘটবে শ্রমিকদের ভাগ্যে : জানা গেছে, অবৈধ কর্মীদের জন্য নতুন করে ‘ফ্রি প্লাস ওয়ান’ পদ্ধতিতে দেশে ফেরার সুযোগ করে দিয়েছে মালয়েশীয় সরকার। মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন বিভাগ অবৈধ শ্রমিকদের নিজ নিজ দেশে ফেরত যেতে নতুন এ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দিয়েছে। ‘ফ্রি প্লাস ওয়ান’ পদ্ধতিতে যেকোনো অবৈধ বিদেশি শ্রমিক ৪০০ রিংগিত জরিমানা এবং কুয়ালালামপুর-ঢাকা বিমানের টিকেট নিয়ে পুত্রাজায়ার ইমিগ্রেশনে গেলেই তাকে দেশে ফেরার জন্য সুযোগ দেওয়া হবে। তাছাড়া অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেফতার করে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে ইমিগ্রেশন পুলিশ ছক তৈরি করেছে। মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনের তৈরি করা ছক পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশটিতে থাকা অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেফতার করে উচ্ছেদ করা পর্যন্ত ফর্মুলাকে তারা মোট আট ভাগে ভাগ করেছে। কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে গ্রেফতার এবং সর্বশেষ যার যার দেশে ফেরত পাঠানো হবে এ ফর্মুলায়। এক নম্বরে রয়েছে আদুয়ান (অভিযোগ), ২. রিসিকান (গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ), ৩ অপারেসি (ধরপাকড়), ৪. সিয়াসাটান (তদন্ত), ৫. পেনডাকওয়ান (প্রসিকিউশন) ৬. কামপাউন (জরিমানা), ৬(২). পেনজারা/ডেনডা (জেল) এবং ৭ নম্বরে পেনগুসিরান (উচ্ছেদ বা দেশে ফেরত)। এই ছক তৈরি করে ইমিগ্রেশনের পক্ষ থেকে অবৈধ অভিবাসীদের ধরিয়ে দিতে বেশ কিছু ফোন ও ই-মেইল নম্বর দেওয়া রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে চলমান সঙ্কট নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শ্রমবাজার বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারম্যান ড. তাসনিম সিদ্দিকী সকালের খবরকে বলেন, দীর্ঘ পাঁচ বছর বন্ধ রাখার পর মালয়েশীয় সরকার গত মার্চ থেকে আবারও বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়া শুরু করেছে। তাই আমাদের এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে দেশটির সরকার আবারও বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া। এবার চলমান সঙ্কট নিয়ে আমি বলব, অসচেতনতার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সে দেশে কর্মরত শ্রমিকদের যেমন অসচেতনতা রয়েছে, তেমনি সে দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদেরও গাফিলতি রয়েছে। মালয়েশিয়া সরকারকে দোষারোপের কোনো সুযোগ নেই। কারণ তারা তো বৈধ হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। কেন সে সুযোগটি গ্রহণ করা গেল না। সুতরাং সবার গাফিলতিতেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আমি মনে করি, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীকে দ্রুত সে দেশে সফরে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কটের সমাধান বের করতে হবে।