চিকিত্সকসহ হাসপাতালের সবার স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে প্রায় দুই মাস পর আলাদাভাবে বাবা-মায়ের কোলে চড়ে যমজ দুই বোন তোফা ও তহুরা বাড়ি ফিরেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম রোববার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গিয়ে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানিয়েছেন। বাড়ি ফেরা উপলক্ষে চিকিত্সকদের দেওয়া নতুন গোলাপি রঙের জামা, চুড়ি, জুতা আর মাথায় ব্যান্ড পরিয়ে পুতুলের মতো করে সাজানো হয়েছিল তোফা-তহুরাকে। তাদের মা শাহিদা বেগম পরেছিলেন চিকিত্সকদের দেওয়া নতুন শাড়ি, বাবা রাজু মিয়া পরেছিলেন নতুন লুঙ্গি-শার্ট। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের সভাকক্ষে বিদায় অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তহুরাকে কোলে নিয়ে আদর করেন এবং তাদের বাবার হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে হাসপাতালের ছাড়পত্র তুলে দেন। এ সময় সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তোফা ও তহুরার বাবা রাজু মিয়ার জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন। তোফা ও তহুরার আরও দুটি অস্ত্রোপচার বাকি আছে। এ ছাড়া প্রতিমাসে তাদের ফলোআপ করতে ঢাকায় আসতে হবে। তাই ঢাকায় কাজ পেলে ভোগান্তি কমবে বিবেচনায় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তোফা ও তহুরার বাবা রাজু মিয়ার জন্য এখানে একটি চাকরির অনুরোধ জানানো হলে মন্ত্রী এ আশ্বাস দেন। মন্ত্রী বলেন, তোফা-তহুরার বাবার চাকরির বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। আমরা চাই তারা ভালো থাকুক। মানসম্মত ও উন্নত চিকিত্সায় তারা বড় হয়ে উঠুক। আমি অবশ্যই পরিবারটিকে দেখব। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহনুর ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তোফা ও তহুরা ভালো আছে। অন্য শিশুর মতো স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া করছে। তোফা বসতে শিখেছে। তবে তাদের আরও দুবার অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন হবে। জ্যেষ্ঠ চিকিত্সকদের সঙ্গে আলোচনা করে পরে দিনক্ষণ ঠিক করা হবে। এখন তাদের পুনর্বাসনের প্রয়োজন। তাই তাদের বাবা-মায়ের নামে ডাচ-বাংলা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগ থেকে বাবা রাজু মিয়া ও মা শাহিদা বেগমের নামে খোলা এই যৌথ অ্যাকাউন্ট হল- ডাচ-বাংলা ব্যাংক, হিসাব নম্বর ১৩৯১৫১৭৩৭৪০, ইমামগঞ্জ শাখা। প্রধানমন্ত্রী ও দেশবাসীর পক্ষ থেকে চিকিত্সকদের শুভেচ্ছা জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, চিকিত্সকরা তোফা ও তহুরাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। আজ তারা বাবা-মায়ের কোলে করে বাড়ি ফিরছে, এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কিছু নেই। তাদের চিকিত্সায় যুক্ত চিকিত্সকদের দল যেভাবে কাজ করেছে, তিনি তা অন্যদের অনুসরণ করতে বলেন। একই সঙ্গে তোফা-তহুরার প্রতি সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এদের সাহায্য করলে ভবিষ্যতে হয়তো তারা নিজেরাই চিকিত্সক হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, চিকিত্সকদের এ ধরনের সফলতা অন্য চিকিত্সকদের কাছে স্মরণীয়। মুক্তামণি, আদুরি কিংবা আবুল বাজনদাররা মানসম্মত চিকিত্সা পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে। এ ধরনের সুচিকিত্সায় যারা জড়িত তাদের জন্য দেশবাসী দোয়া করছে। রোহিঙ্গা সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মানুষ অনেক উদার। মানবিক বলেই লাখ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় পাচ্ছে। আমরা সীমান্ত বন্ধ করে দেইনি, নৌপথ বন্ধ করে দেইনি। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসিরউদ্দিনসহ বিভিন্ন বিভাগের চিকিত্সক ও নার্সরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দহবন্দ ইউনিয়নের ঝিনিয়া গ্রামের কৃষক রাজু মিয়ার স্ত্রী শাহিদা বেগম নিজবাড়িতে শরীর জোড়া লাগানো অবস্থায় তোফা-তহুরার জন্ম দেন। কোমরের কাছে জোড়া লাগানো শিশু দুটির সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই ছিল। তবে জন্ম থেকেই তাদের প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা একটি ছিল। গত বছরের ২০ অক্টোবর প্রথমবার ঢামেক হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে তাদের পায়ুপথের রাস্তা পৃথক করা হয়। এরপর গত ১৬ জুলাই আবার তাদের ঢামেকের শিশু সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয়। আর ১ আগস্ট চিকিত্সকদের প্রায় ৩০ জনের একটি দল দীর্ঘ ৯ ঘণ্টার অস্ত্রোপচার শেষে জোড়া লাগানো তোফা ও তহুরাকে আলাদা করেন। শাহিদা বেগম ও রাজু মিয়া দম্পতির পাঁচ বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে।