জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর ও আশপাশের এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এর অংশ হিসেবে সব ধরনের আবাসিক হোটেলে বোর্ডার তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে পুলিশ প্রশাসন। এত সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও পান্থপথের হোটেল ওলিওতে আত্মঘাতী জঙ্গি সাইফুল ইসলামসহ ২৪ বোর্ডার কীভাবে প্রবেশ করল। এ ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে পুলিশ প্রশাসনে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, স্পর্শকাতর ওই এলাকায় ৩ দিন আগে থেকেই সব ধরনের আবাসিক হোটেলে বোর্ডার তোলা নিষিদ্ধ করা হয়। ঘটনার দিন ওলিও থেকে ২৩ জন বোর্ডার ও হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয় থানায়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা নিহত জঙ্গি সাইফুলের বিষয়ে কিছু জানা নেই বলে জানান। তবে প্রশ্ন উঠেছে, সাইফুল যে ট্রলি ব্যাগ নিয়ে ওই হোটেলে প্রবেশ করে সেই হোটেল কর্তৃপক্ষ কোনো তল্লাশি ছাড়াই কীভাবে তাকে রুম ভাড়া দিয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হোটেল ওলিওতে নিহত জঙ্গি সাইফুল আত্মঘাতী হওয়ার পর জানা গেছে সে জঙ্গি সংগঠনের ‘ফিদায়ী স্কোয়াড’ সদস্য। ছোট গ্রুপটি ভাগ হয়ে দলবদ্ধভাবে তারা ফিদায়ী স্কোয়াড নাম দিয়েছে। ফিদায়ী স্কোয়াড আত্মঘাতী হামলার জন্য শুধু ঢাকাতেই প্রস্তুত রেখেছে অর্ধশত সদস্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একের পর এক অভিযানে জঙ্গিরা গ্রেফতার, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ও আত্মঘাতী হয়ে নিহত হওয়ার পর সদস্য সঙ্কটে পড়ে যায় জঙ্গিরা। জঙ্গিদের সংগঠিত করতে বিদেশি দাতাদের কাছ থেকে অর্থ চাওয়া হলেও হামলার প্রমাণ ছাড়া অর্থ দিতে নারাজ বিদেশিরা। তাই বড় কোনো নাশকতা সৃষ্টি করে বিদেশিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের পর জঙ্গিরা ফের ঘুরে দাঁড়াতে চায় বলে গোয়েন্দা সূত্র জানায়। সূত্র আরও জানায়, ফিদায়ী স্কোয়াডের প্রায় অর্ধশত সদস্য নির্দিষ্ট একটি স্থান বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের অপারেশনাল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। কে কখন হামলা চালাবে-তা নিজেরাই নির্ধারণ করে। হামলার আগে সদস্যরা ঘটনাস্থল রেকি করে। সে অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে। হামলার আগের দিন অন্য সদস্যরা যে আত্মঘাতী হামলায় অংশ নেবে বোমা তার কাছে পৌঁছে দেয়। এরপরই সে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে নিহত হয়। গত মঙ্গলবার রাজধানীর পান্থপথে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অদূরে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত সাইফুল ইসলাম ফিদায়ী স্কোয়াডের সদস্য ছিল। ওই হোটেলের বাইরে আত্মঘাতী হামলায় আরও ৪ থেকে ৫ জন ছিল বলে পুলিশ সূত্র জানায়। সূত্র জানায়, গত সোমবার রাত পৌনে ৩টার দিকে নিউমার্কেট থানার ওসি মো. আতিকুর রহমানের নেতৃত্বে হোটেল ওলিওতে অভিযান চালানো হয়। এ সময় নিউমার্কেট থানা থেকে দুটি, কলাবাগান থানার একটি ও হাজারীবাগ থানার একটি মোবাইল টিম নিয়ে পুরো হোটেলটিতে তল্লাশি চালানো হয়। হোটেলের চতুর্থ তলার ৩০১ নম্বর রুমে ছিল জঙ্গি সাইফুল ইসলাম। ওই রুমে ওসি আতিকুর রহমান সাইফুলকে দরজা খুলতে বললেও সে সাফ জানিয়ে দেয় সকালে দরজা খুলবে। পুলিশ পরিচয়ের পরও দরজা না খোলা হলে তখন সন্দেহ হয় পুলিশের। এক পর্যায়ে রাত সোয়া ৩টার দিকে এন্ট্রি খাতায় তল্লাশি করে তার নাম খায়রুল ইসলাম লেখা দেখেন। আর স্বাক্ষর করা হয় সাইফুল নামে। ওসি আতিকুর রহমান এন্ট্রি খাতায় স্বাক্ষর দেখার পরই পুরো বিষয়টি তার নজরে আসে। পরে তাত্ক্ষণিকভাবে খোঁজ নিয়ে জানেন, গত ২০ জুলাই খুলনার ডুমুরিয়ার বান্ধা বটতলা গ্রামের ছোট বাজারে যতীন্দ্রনাথ গাতিমারের চায়ের দোকানে প্রেশারকুকার বোমার বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটিয়েছিল সাইফুল ইসলাম। তার বাড়িও ডুমুরিয়ার সাহস ইউনিয়নের নোয়াকাঠি গ্রামে। সাইফুলের সেটি ছিল প্রথম পরীক্ষা। এরপরই সাইফুল ফিদায়ী স্কোয়াডের সদস্য হয়ে শোক দিবসের কর্মসূচিতে আত্মঘাতী হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। নিউমার্কেট থানার ওসি আতিকুর রহমান সকালের খবরকে বলেন, ওই দিন সাইফুলের সন্ধান না পেলে সে তার সহযোগীদের নিয়ে বড় ধরনের নাশকতার সৃষ্টি করত। তার সঙ্গে আরও ৪ থেকে ৫ জন হোটেলের বাইরে ছিল তাকে লিড দেওয়ার জন্য। সাইফুল পুলিশের নজরদারিতে আসার পর তারা সটকে পরে। তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সকালের খবরকে বলেন, সাইফুল ওই হোটেলে কীভাবে প্রবেশ করেছে তা এর মধ্যে সবাই জেনেছে। আমাদের গোয়েন্দারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আরও কারা সেখানে অবস্থান করছিল তা জানতে। হোটেলটিতে সাইফুলের সঙ্গে কেউ থাকলে তাকেও গ্রেফতার করা হবে। বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। আর সেখানে পুলিশের কারও গাফিলতি থাকলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্পর্শকাতর এলাকা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের ২০০ মিটারের মধ্যে ওলিও হোটেলে আত্মঘাতী জঙ্গির আস্তানার সন্ধান পাওয়ার পর সেখানকার নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেই রাতে জঙ্গি সাইফুলকে শনাক্ত করা না গেলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো বলে মনে করেন গোয়েন্দারা। ঘটনার দিন সংবাদ সম্মেলনেও পুলিশের আইজি বলেছেন, শোক দিবসের মিছিলে হামলার পরিকল্পনা ছিল। যাতে করে শত শত লোকের প্রাণহানি ঘটাতে পারত। পুলিশের সূত্রগুলো জানান, জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাওয়ার বিষয়টি ছিল পূর্বনির্ধারিত। আর এ কারণেই ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরকে কেন্দ্র করে তিন ধাপের কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়। এরই অংশ হিসেবে ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছাকাছি ধানমণ্ডি, কলাবাগান, শেরেবাংলা নগর, হাজারীবাগ ও নিউমার্কেট থানার সব আবাসিক হোটেলে বোর্ডার তোলা নিষিদ্ধ করে পুলিশ। এরপরও কীভাবে কলাবাগান থানার হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে (আবাসিক) ১৫ আগস্টের আগের দিন বোর্ডার তোলা হল তা খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দাদের ধারণা, কলাবাগান থানা পুলিশ বিষয়টি হয়তো কঠোরভাবে অনুসরণ করেনি বলেই হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে বোর্ডার ছিল। সেই সুযোগ নিয়েছে জঙ্গিরা। এত কড়াকড়ি থাকার পরও বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে মাত্র দুইশ’ মিটার দূরের এই হোটেলে বর্ডার থাকল কীভাবে, তা-ই এখন খতিয়ে দেখছেন তারা। স্থানীয় সূত্র জানায়, হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো নয়। রাতে মাত্র একজন নিরাপত্তাকর্মী সেখানে থাকেন। সিসি ক্যামেরাও অকেজো। এসব বিষয় জেনেশুনেই হয়তো জঙ্গিরা এই হোটেলে উঠেছিল। ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মারুফ হোসেন সরদার বলেন, আমরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছি। যে কারণে এ বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ওই ঘটনায় কলাবাগান থানায় এসআই ইমরুল সাহেদ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেন। তদন্তের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না বলে জানান ডিসি। উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার রাজধানীর পান্থপথের ওলিও ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় জঙ্গি সাইফুল ইসলাম।