সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিয়ে এখন হিসাব মেলাচ্ছে বাংলাদেশ। আর ৯ উইকেটে একপেশে এই ম্যাচ জিতে ভারত এখন ফাইনালে। আইসিসির ইভেন্টে আরেকবার ‘ড্রিম ফাইনাল’ হচ্ছে ভারত বনাম পাকিস্তান। স্বপ্ন তো বাংলাদেশও দেখেছিল। ফাইনালে খেলার। তবে সেই স্বপ্ন সফল করার জন্য যে ‘উপকরণ’ প্রয়োজন ছিল-তার পুরোটুকুর জোগাড় হল না। না ব্যাটিংয়ে না বোলিংয়ে! এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তিনশ’ রানও যেখানে নিরাপদ কিছু নয়। সেখানে বাংলাদেশের গড়া ২৬৪ রানকে তেমন বড় স্কোর বলতেও কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকছে! জবাবি ইনিংসে ভারত ৫৯ বল বাকি থাকতে ৯ উইকেটে সেমিফাইনাল জিতে প্রমাণ করল-এ টুর্নামেন্টে ২৬৪ রান তুলে ম্যাচ বাঁচানো যায় না। আসলে সেমিফাইনালের প্রায় সবকিছুই যেন হল এবং ঘটল ভারতের চাওয়ামতোই। মেঘলা আবহাওয়ায় আগে বোলিংয়ের সুবিধাটা নিল তারা। আবার যখন ব্যাট করতে নামল তখন ঝাঁ চকচকে রোদ এজবাস্টনের আকাশজুড়ে। কোনো বাতাস নেই। উইকেট পুরোদস্তুর আরও বেশি ব্যাটিংবান্ধব। উইকেটে বিন্দুমাত্র সুইং নেই। স্পিনও ধরে না। ভারতের ব্যাটিংয়ের সময় মনে হচ্ছিল সিমেন্টের উইকেটে ব্যাটিংটা হচ্ছে! ওপেনিং জুটিতেই রোহিত শর্মা আর শিখর ধাওয়ান তুলে নেন ৮৭ রান। মাশরাফির বলে ৪৬ রানে যদিওবা ধাওয়ান আউট হলেন, বাকিটা অনায়াসে শেষ করলেন সেঞ্চুরিয়ান রোহিত আর অধিনায়ক বিরাট কোহলি। রোহিত অপরাজিত থাকলেন ১২৯ বলে ১৫ চার ও ১ ছক্কায় ১২৩ রানে আর কোহলি সাজঘরে ফিরলেন হার না মানা ৭৮ বলে ১৩ বাউন্ডারিতে ৯৬ রানে। ম্যাচ খতম। হতাশার শুরু টস পর্বেই। টস ভাগ্য মাশরাফির কখনই তেমন ভালো নয়। এ ম্যাচেও সেটা মন্দই রইল। টস জিতে বিরাট কোহলি বোলিং বেছে নিলেন। মাশরাফিও বোলিংটাই আগে করতে চেয়েছিলেন। এজবাস্টনের আবহাওয়া, কন্ডিশন-সবকিছুই ছিল বোলিংয়ের অনুকূলে। সকালের ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। হিমহিম ঠাণ্ডা। বাতাসে ভরা জলীয় বাষ্পের কণা। পেস বোলিংয়ের জন্য একেবারে আদর্শ কন্ডিশন। সেই কন্ডিশনকে আরও ভারতের অনুকূলে করে দিলেন ওপেনার সৌম্য সরকার। ম্যাচের প্রথম ওভারেই ব্যাটে লাগিয়ে বলকে ভেতরে টেনে এনে বোল্ড সৌম্য। বল ব্যাটে লাগার পরমুহূর্তে পেছনে স্টাম্প ভাঙার শব্দটা শুনেই চোখ বুজে ফেললেন সৌম্য-হতাশায়! তবে প্রথম ওভারের সেই হতাশা কাটিয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ সাব্বির রহমানের ব্যাটে। তিন নম্বরে নামা ব্যাটসম্যানকে ‘প্রভাবী ব্যাটিং’ করতে হয়-এ তত্ত্বকে আদর্শ মানা সাব্বির আক্রমণাত্মক ক্রিকেটই খেলছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে শুরুতে বেশি আক্রমণাত্মক হলে বিপদে পড়তে হয়-সেটা যখন বুঝলেন ২১ বলে ৪ বাউন্ডারিতে ১৯ রানে আউট হয়ে। অনেক বাইরের বল খেলতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিলেন। স্কোর বোর্ডে বাংলাদেশ তখন ৩১ রানে ২ উইকেট হারানো দল। টুর্নামেন্টের প্রথম দিন থেকেই তামিম প্রমাণ করে চলেছেন-এ কন্ডিশনে ব্যাটিংটা সবচেয়ে ভালো তারই জানা। রক্ষণের সঙ্গে আক্রমণের মিশেল ঘটিয়ে তামিম এ ম্যাচেও দলকে বিপদের গর্ত থেকে উদ্ধার করেন। সঙ্গী হিসেবে পান মুশফিকুর রহিমকে। এ দুজনের ব্যাটিংটা যতই লম্বা হচ্ছিল ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলির মুখে চিন্তার রেখা ততই বাড়ছিল। বেচারা হার্দিক পান্ডেকে বাধ্য হয়ে কোহলি আক্রমণ থেকে সরিয়ে নেন। দুই স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন এবং রবীন্দ্র জাদেজার শুরুটাও তেমন প্রভাবী কিছু ছিল না। তামিম-মুশফিক তৃতীয় উইকেটে বলা যায় প্রায় অনায়াস ভঙ্গিতেই সেঞ্চুরির জুটি গড়েন। উপায়ান্তর না দেখে প্ল্যান ‘বি’র পথে হাঁটেন কোহলি। পার্টটাইম বোলার কেদার যাদবের হাতে বল তুলে দেন। দারুণ কাজে দেয় কোহলির এ কৌশল। স্পিন নিয়ে কেদার আক্রমণে আসার পরের ১০ ওভারে বাংলাদেশের রানের চাকা গতি হারায়। ম্যাচে বাংলাদেশের দুই সেরা ব্যাটসম্যান তামিম এবং মুশফিকের উইকেটও শিকার করেন বোলিংয়ে বাংলাদেশের কাছে প্রায় অপরিচিত এই কেদার যাদব। দলে মূলত খেলেন ফিনিশার ব্যাটসম্যান হিসেবে। কিন্তু কালকের সেমিতে বল হাতেই দলের হয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখলেন এ অফ স্পিনার। ছয় ওভারে ২২ রানে ২ উইকেট। তার এই দুই উইকেটের প্রথমটি ৮২ বলে ৭ চার ও ১ ছক্কায় ৭০ রান করা তামিমের। দ্বিতীয়টি ৮৫ বলে ৬১ রান তোলা মুশফিকের। এ দুই উইকেটের মাঝখানে জাদেজা ফিরিয়ে দেন সাকিব আল হাসানকে। পাঁচ বলের ব্যবধানে সাকিব ও মুশফিকের উইকেট হারানো বাংলাদেশের ব্যাটিং হঠাত্ করেই যেন এলোমেলো হয়ে পড়ে। শর্ট মিডউইকেটে মুশফিকের ক্যাচটা ধরার পর বিরাট কোহলির উল্লাস জানান দিচ্ছিল-সেমিফাইনালের অর্ধেকটা জেতা হয়ে গেছে তাদের! জাসপ্রিত বুমরাহর বোলিংয়ের সঙ্গে লড়তে পারলেন না মাহমুদউল্লাহ ও মোসাদ্দেক। শর্ট বল সামাল দিতে না পেরে একেবারে গোবেচারা টাইপের আউট হলেন মোসাদ্দেক। আর মাহমুদউল্লার বোল্ড হলেন বুমরাহর বিউটি বলে-ইয়র্কড! ২৮ ওভারে ৩ উইকেটে ১৫৪ রান তোলা বাংলাদেশ বেশ জোরালোভাবেই তিনশ’ ছাড়ানোর স্বপ্ন বুনছিল। কিন্তু দলের মূল সাত ব্যাটসম্যান যে আউট। তারপরও স্কোর ২৬৪ রানে পৌঁছানোর জন্য মাশরাফি একটা পিঠ চাপড়ানোর ধন্যবাদ পেতে পারেন। ২৫ বলে ৫ বাউন্ডারিতে বাংলাদেশ অধিনায়কের ব্যাট হাসল অপরাজিত ৩০ রানে। -স্ট্রাইকরেট কত জানেন? ১২০! এমন ব্যাটিং যে মাঝের ব্যাটসম্যানদের কেউ করতে পারলেন না। তাই দলের স্কোরটা লড়াকু হল ঠিকই। কিন্তু সেমিফাইনাল জেতার মতো নয়! সংক্ষিপ্ত স্কোর বাংলাদেশ : ২৬৪/৭, ৫০ ওভার (তামিম ৭০, সাব্বির ১৯, মুশফিক ৬১, সাকিব ১৫, মাহমুদউল্লাহ ২১, মোসাদ্দেক ১৫, মাশরাফি ৩০*, তাসকিন ১০*; ভুবনেশ্বর ২/৫৩, বুমরাহ ২/৩৯, কেদার যাদব ২/২২)। ভারত : ২৬৫/১, ৪০.১ ওভার (রোহিত ১২৩*, ধাওয়ান ৪৬, কোহলি ৯৬*; মাশরাফি ১/২৯)। ফল : ভারত ৯ উইকেটে জয়ী। ম্যাচসেরা : রোহিত শর্মা।