দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজটা এমনিতেই ছিল অগ্নিপরীক্ষার আরেক নাম। বাংলাদেশ দলের জন্য সেটি আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে সাকিব আল হাসান থাকছেন না বলে। টানা ক্রিকেট খেলার ক্লান্তি ঘোচাতে বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডারকে বিশ্রাম দেওয়া হচ্ছে এই সিরিজে।
‘বিশ্রাম দেওয়া হচ্ছে’ না লিখে অবশ্য ‘বিশ্রাম নিচ্ছেন’ লেখা উচিত। কারণ এটা বোর্ড বা নির্বাচকদের সিদ্ধান্ত নয়। বিশ্রামটা সাকিব নিজেই চেয়েছেন। চেয়েছিলেন আরও লম্বা সময়ের জন্য।
একটি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্টের পরই বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসানকে নিজের ইচ্ছার কথা জানান সাকিব। টানা ক্রিকেট খেলতে খেলতে ক্লান্তির কথা বলে টেস্ট ক্রিকেট থেকে ছয় মাসের ছুটি চান। এই সময় ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি খেলবেন জানিয়ে বলেন, এই বিরতিটা পেলে তিনি আবার নতুন উদ্যমে ফিরতে পারবেন। কাল আনুষ্ঠানিকভাবে বোর্ডকে চিঠি দিয়েছেন সাকিব। যেটিতে একই ইচ্ছার কথাই লিখেছেন।
সাকিবের আনুষ্ঠানিক আবেদনের আগেই বোর্ড সভাপতি এ নিয়ে বোর্ড পরিচালকদের সঙ্গে দফায় দফায় অনানুষ্ঠানিক সভা করেছেন। যাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সাকিব শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজটাই ছুটি পাবেন। আগামী ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজেই ফিরতে হবে তাঁকে।
সাকিব যে ছয় মাসের জন্য ছুটি চেয়েছিলেন, বর্তমান সূচি অপরিবর্তিত থাকলে এই সময়ে বাংলাদেশের চারটি টেস্ট খেলার কথা। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে দুটি। এরপর ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার বাংলাদেশ সফরে দুটি। আগের সূচি অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাওয়ার কথা ছিল। সেটি অবশ্য পিছিয়ে আগামী জুলাইয়ে চলে যাওয়া একরকম নিশ্চিতই।
ক্লান্তি অবশ্য সাকিবকে পেয়ে বসতেই পারে। বাংলাদেশের সবচেয়ে ‘ব্যস্ত’ ক্রিকেটার তিনি। ক্রিকেটের তিন সংস্করণের বাংলাদেশ দলে তো অপরিহার্যই, বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতেও সাকিব নিয়মিত মুখ। যেগুলোয় খেলার চেয়েও বেশি ক্লান্তিকর এক শহর থেকে আরেক শহরে ভ্রমণের ঝক্কি।
৫১টি টেস্ট খেলেছেন, ১৭৭টি ওয়ানডে, সঙ্গে ৫৯টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি। এর সঙ্গে যোগ করুন বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি লিগে খেলা ১৭৮টি ম্যাচ। ব্যাটে-বলে একই রকম আলো ছড়ানোর ক্ষমতার কারণে তাঁর ওপর চাপও পড়ে অনেক বেশি। টি-টোয়েন্টির আবির্ভাবের পর এই চাপ থেকে বাঁচতে গত কিছুদিন অনেক ক্রিকেটারই কোনো না কোনো সংস্করণ থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছেন। ‘কষ্ট বেশি, টাকা কম’—এই কারণে টেস্ট ক্রিকেট বিসর্জন দেওয়ার ঘটনাই বেশি। সাকিবও এমন কিছুর কথা ভাবছেন না তো! মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাকিব কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সাকিবের ঘনিষ্ঠ মহলসূত্রে জানা গেছে, আপাতত এ রকম কোনো চিন্তা নেই। একটু বিশ্রাম নিয়ে তরতাজা হয়ে ফেরাটাই টেস্ট ক্রিকেট থেকে সাকিবের সাময়িক ছুটি চাওয়ার উদ্দেশ্য।
সেটি হলেই ভালো। কারণ সাকিব না-থাকা মানে দলের ‘দুজন’ খেলোয়াড় কমে যাওয়া। ব্যাটিংয়ে তিনি দলের নির্ভরতা, বোলিংয়ে তো আরও বেশি। রেকর্ডেও এর প্রমাণ। ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫০তম টেস্ট শেষে তাঁর রেকর্ড নিয়ে হইচই হয়েছে পুরো ক্রিকেট-বিশ্বেই। আশির দশকের বিখ্যাত চার অলরাউন্ডার ইমরান-বোথাম-হ্যাডলি-কপিল বলুন, বা এর আগে-পরের ক্ষণজন্মা দুই অলরাউন্ডার সোবার্স বা ক্যালিস, সাকিবের মতো আর কারোরই যে ৫০ টেস্ট শেষে তিন হাজার রান ও দেড় শ উইকেট ছিল না।
২০০৭ সালের মে মাসে টেস্ট অভিষেকের পর বাংলাদেশ যে ৫৮টি টেস্ট খেলেছে, তার ৫১টিতেই ছিলেন সাকিব। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের দুই সিরিজের ৩টি টেস্টে বাদ পড়েছিলেন। সর্বশেষ সেই ২০০৮ সালে। এরপর পারফরম্যান্সের কারণে আর কখনো দল থেকে বাদ পড়ার প্রশ্নই ওঠেনি। সাম্প্রতিক অতীতে দুটি টেস্ট সিরিজ মিস করেছেন। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে যেতে পারেননি পায়ের চোটের কারণে। পরের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাওয়া হয়নি ‘অসদাচরণে’র জন্য ছয় মাস নিষিদ্ধ ছিলেন বলে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শুরুই হবে টেস্ট সিরিজ দিয়ে। ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে প্রথম টেস্ট, দ্বিতীয় টেস্ট শুরু ৬ অক্টোবর। ৩টি ওয়ানডে ও দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হবে এরপর। সাকিবের অভিষেকের পর একবারই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গেছে বাংলাদেশ দল। ২০০৮ সালের সেই সিরিজ থেকে বাংলাদেশ কিছু না পেলেও (২০০২ সালে আগের সফরের মতো দুই টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হার) সাকিবের ব্যক্তিগত সুখস্মৃতি আছে। দুই টেস্টে পরপর দুই ইনিংসে নিয়েছিলেন ৫ ও ৬ উইকেট। শেন ওয়ার্ন ও অনিল কুম্বলের মতো স্পিনারেরও দক্ষিণ আফ্রিকায় টানা দুই ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার এই কীর্তি নেই। মুত্তিয়া মুরালিধরনের আছে মাত্র একবার।