চলমান বন্যায় রাজশাহী, জামালপুর, দিনাজপুর, নওগাঁ ও সিরাজগঞ্জে আরও ৬ জন মারা গেছেন। পদ্মা নদীর পানি গতকাল আরও বেড়েছে। বর্তমানে বিপদসীমার ১০২ সেমি ওপর দিয়ে বইছে এ নদী। ফলে এ নদীর অববাহিকায় অবস্থিত ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তীব্র হয়েছে নদীভাঙন।
ছবিঃ আকবর রাব্বী
রাজশাহী : জেলার বাগমারায় বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সকালে উপজেলার গোবিন্দপাড়া ইউনিয়নের শালজোড় শ্মশানঘাট এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত গৃহবধূ জয়নব বিবি (৪২) ওই ইউনিয়নের রমজানপাড়া গ্রামের আবু সাঈদের স্ত্রী। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে রমজানপাড়া গ্রামের বন্যায় ভেঙে যাওয়া রাস্তার ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় স্রোতের টানে ভেসে যান জয়নব।
ছবিঃ আকবর রাব্বী
জামালপুর : জেলার সরিষাবাড়ীতে বন্যার পানিতে ডুবে সুলতান মাহমুদ (৪২) নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। কামরাবাদ ইউনিয়নের শুয়াকৈর গ্রামের মৃত শুকুর মণ্ডলের ছেলে সুলতান মাহমুদ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পানির স্রোতে ভেসে নিখোঁজ হন। গতকাল দুপুরে বাড়ির পাশ থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এদিকে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ভাটারা ইউনিয়নের ইজারাপাড়া এলাকায় সরিষাবাড়ী-জামালপুর সড়কে ভাঙনের সৃষ্টি হওয়ায় উপজেলার সঙ্গে জেলা শহর ও অন্যান্য উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তবে যমুনার পানি কমতে থাকায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এখনও বিপদসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যমুনা।
ছবিঃ আকবর রাব্বী
দিনাজপুর : জেলায় বন্যায় আরও এক শিশু ও তরুণের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দিনাজপুরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৩১ জনে। গতকাল সকালে বিরলের বিজোড়া ইউপির মুরাদপুর গ্রামের খায়রুল ইসলামের পুত্র নাইমুর রহমান নাঈমের (১৭) লাশ রেললাইনের নিকটবর্তী স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়। সে গত ১৩ আগস্টে বন্যার পানির স্রোতে ভেসে যায়। অপরদিকে খানসামা উপজেলার হোসেনপুর কানার মোড় এলাকার আয়নালের ছেলে হূদয় (৪) বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পানির স্রোতে পুকুরে ভেসে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে রাতে তার লাশ উদ্ধার করে স্বজনরা।
সিরাজগঞ্জ : জেলার তাড়াশে মো. সিয়াম (১০) নামে এক শিশু সাপের কামড়ে মারা গেছে। সিয়াম উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নের সাকুয়া দিঘী গ্রামের মো. জিয়াউর রহমানের ছেলে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাকুয়া দিঘী গ্রামে এ ঘটনা। নওগাঁ : জেলার রাণীনগরে বেড়িবাঁধ ভাঙনে পানির স্রোতে পড়ে অজিত চন্দ্র (৫৫) নামের কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলার কৌনজ ঋষিপাড়া গ্রামের বেড়িবাঁধ ভাঙনে এ ঘটনাটি ঘটেছে। অজিত চন্দ্র উপজেলার কৌনজ ঋষিপাড়া গ্রামের মৃত সশির ছেলে।
ছবিঃ আকবর রাব্বী
রাজবাড়ী : পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এ জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে চারটি উপজেলার প্রায় ২৭ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে জেলার ৩৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বন্যার পানিতে নষ্ট হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৯৪৪ হেক্টর ফসলি জমি। গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া গেজ স্টেশন পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমার ১০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তীব্র স্রোতের কারণে কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গোয়ালন্দে দুর্গত হাজার হাজার পরিবারের মাঝে কোনো সহযোগিতা পৌঁছায়নি। বন্যার পানিতে রেললাইন ডুবে যাওয়ায় গতকাল সকাল থেকে বন্ধ হয়ে গেছে গোয়ালন্দ বাজার থেকে দৌলতদিয়া ঘাটের রেল যোগাযোগ।
ছবিঃ আকবর রাব্বী
টাঙ্গাইল : দেলদুয়ারে ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় দেউলী ইউনিয়নের বাবুপুর, সুবর্ণতলী, ঝুনকাই, ব্রাহ্মণখোলা, আত্রাব, আলালপুর, বেংরাইলসহ ১০টি গ্রামের প্রায় ৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। লাউহাটীর বিখ্যাত গরুর হাট ২ ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। কয়েকশ’ একর সবজি ও লেবু বাগান বানের পানিতে ভাসছে।
মাদারীপুর : জেলার শিবচরে আড়িয়ল খাঁ নদের ওপর নির্মাণাধীন দ্বিতীয় সেতুর স্টোকইয়ার্ড নদীভাঙনে আক্রান্ত হয়েছে। স্টোকইয়ার্ডের ১শ’ থেকে দেড়শ’ মিটার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। তাই স্টোকইয়ার্ড থেকে দ্রুত মালামাল সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পদ্মা ও আড়িয়ল খাঁর ভাঙনে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ২টি মাদ্রাসা, ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২ শতাধিক ঘর-বাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হয়েছে। নদীভাঙন মারাত্মক আকার ধারণ করায় আক্রান্তরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। হুমকিতে রয়েছে একাধিক স্কুল, ১টি ইউনিয়ন পরিষদসহ শত শত ঘরবাড়ি। পদ্মায় অস্বাভাবিকহারে পানি ও তীব্র স্রোতের কারণে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী ইলিয়াছ আহম্মেদ চৌধুরী রুটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ডুবে গেছে কাঁঠালবাড়ীর ৩টি ফেরিঘাট সংলগ্ন পন্টুন ও সড়ক। স্রোতের গতিবেগ বেড়ে যাওয়ায় ফেরিসহ নৌযান পারাপারে বিলম্ব হচ্ছে। উভয় ঘাটে ৫ শতাধিক ট্রাক আটকে আছে।
ফরিদপুর : জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল পর্যন্ত জেলার তিনটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়া বেশ কিছু সড়ক ডুবে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যার কারণে ইতোমধ্যেই ৪৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ফরিদপুরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সাইদুর রহমান জানান, এ পর্যন্ত সহায়তা হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১১৮ টন চাল, নগদ ৩ লাখ টাকা। সদরপুরের একটি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে ৬০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে বলে তিনি জানান।
শরীয়তপুর : জেলার জাজিরা উপজেলার জাজিরা, বড়কান্দি, ডুবলদিয়া, বিকেনগর, বিলাশপুর ও কুণ্ডেরচর ইউনিয়নের চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চলে প্রায় ২০টি গ্রামে বন্যার পনি ঢুকে পড়েছে। নড়িয়া-জাজিরা সড়কটির ঈশ্বরকাঠি এলাকা দিয়ে পানি উঠে যাওয়ায় ওই সড়কটি দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। গবাদি পশু ও শিশুদের নিয়ে চরম উত্কণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ। পদ্মার ভাঙনে নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের ৬০টি পরিবার, চরনাছিরপুর ইউনিয়নের ১১২টি পরিবার, আড়িয়ল খাঁ নদের ভাঙনে চরমানাইর ইউনিয়নের ১৬০টি পরিবার ও ঢেউখালী ইউনিয়নের ৩০টি পরিবারের ঘরবাড়ি, মূল্যবান গাছপালা ও শতাধিক একর ফসলের মাঠ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আড়িয়ল খাঁর ভাঙনে চরমানাইর ইউনিয়নের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী চরবন্দরখোলা ফাজিল মাদ্রাসা ও চরবন্দর খোলা নাদেরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি চরম হুমকির মুখে রয়েছে। ইতোমধ্যে মাদ্রাসা ও বিদ্যালয়ের ২টি ভবন নদীগর্ভে চলে গেছে।
নাটোর : জেলার সিংড়ায় আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পৌরসভার বাজার ও পৌর এলাকার কয়েকশ’ বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। লালমনিরহাট : জেলার পাঁচ উপজেলার অধিকাংশ এলাকা থেকে বন্যার পানি ইতোমধ্যে নেমে গেছে। অব্যাহত রয়েছে খাবার সঙ্কট। ত্রাণ তত্পরতা সন্তোষজনক না হওয়ায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।
কুড়িগ্রাম : জেলায় বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও বেড়েছে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ। বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে চলছে খাবারের জন্য হাহাকার। নৌকা দেখলেই ত্রাণের আশায় ছুটছে দুর্গতরা। দুর্গম চরের মানুষের ভাগ্যে এখনও জোটেনি এক প্যাকেট খিচুড়িও।
চাঁদপুর : জেলার মেঘনা নদী তীরবর্তী এলাকা রাজরাজেশ্বর, লক্ষ্মীপুর, ইব্রাহীমপুর, হানারচর, নীলকমল ইউনিয়নের কিছু এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। গত দুই দিনে নদীতে বিলীন হয়েছে অর্ধশতাধিক বসতভিটা। ইতোমধ্যে ভাঙন আতঙ্কে অনেকই তাদের বাসস্থান ও বিভিন্ন মালামাল নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছে। বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাত্ক্ষণিক বসতভিটা হারানো মানুষের মাঝে শুকনো খাবার ও ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ : বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে (শহররক্ষা বাঁধ হার্ডপয়েন্ট এলাকায়) ১০ সেন্টিমিটার কমেছে। তবে এখনও পানি বিপদসীমার ১৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। জেলার কাজীপুর, সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার ৪৮টি ইউনিয়নের তিন শতাধিক গ্রামের ৪ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে পানিবন্দি মানুষ। জেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজসহ ৪০৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। গবাদিপশুর খাদ্যের সঙ্কটে বিপাকে পড়েছে বন্যাকবলিত মানুষ। জেলার বন্যাকবলিত ৫ উপজেলায় প্রায় ৪শ’ টন চাল ও সাড়ে ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
গাইবান্ধা : করতোয়া নদীর পানি বাড়ায় জেলার পলাশবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় করতোয়া নদীর পানি কাটাখালি পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের চর বালুয়া পয়েন্টের দুটি স্থানে ১০০ মিটার করে ও হাওয়াখানা নামক স্থানে ১৫০ মিটার বাঁধ ভেঙে ৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। জয়পুরহাট : হঠাত্ করে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা ও হারামতী নদীর তীরবর্তী কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শত শত ঘর ভেঙে পড়েছে। স্কুল ও রাস্তার পাশে আশ্রয় নেওয়া বানভাসি মানুষ তীব্র খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে। তাদের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠছে।