(৯)
চৌধুরী সাহেব এত দূর পর্যন্ত ভাবতে পারেননি ৷ কে-ইবা ভাবতে পেরেছে ? আজাদের মা কঠিন মহিলা, কিন্তু তিনি যে হীরার চেয়েও কঠিন, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পদার্থের চেয়েও কঠিন, সেটা একটু একটু করে উদ্ঘাটিত হতে থাকে ৷ এবং যতই দিন যায়, তখন আগের উপলব্ধিটাও যথেষ্ট ছিল না বলে মনে হয় ৷ চৌধুরী সাহেব ভেবেছিলেন, আজাদের মা তাঁর দ্বিতীয় বিয়েটা মেনে নেবে ৷ কেন নেবে না ? তাকে তিনি অর্থে-অন্নে-বস্ত্রে রানীর হালেই রাখতে পারেন ৷ তার বদলে একবস্ত্রে বের হয়ে আজাদের মা কি ভিখিরিনীর মতো করে জীবনযাপন করতে পারবে ? আজাদই কি পারবে এই রাজৈশ্বর্য ছেড়ে গিয়ে দীনহীন জীবন বেছে নিতে ? নিশ্চয় পারবে না ৷ তাদের ফিরে আসতেই হবে ৷
দিন যায় ৷ চৌধুরীর মনোবাঞ্ছা পূরণ হয় না ৷ আজাদের মায়ের নমনীয় হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না ৷ তিনি তাঁর অর্থসাহায্য গ্রহণ করা তো দূরের কথা, মুখটা পর্যন্ত দেখতে নারাজ ৷
আজাদ স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেয় ৷ তার কিছু ভালো লাগে না ৷ বাবার কাছ থেকে যে-মাসোহারা পায়, ওই সময়ে সেই মাসোহারা তার পক্ষে অধঃপাতে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট ৷ মা তার এই মাসোহারার টাকা থেকে কিছুই নেবেন না, একটা পয়সা না, একটা দানা না ৷ সে বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা দেখে ৷ গল্পের বই কেনে ইচ্ছামতো ৷ সন্ধ্যার সময় রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা মারে ৷ তার বন্ধুরা খেলাধুলা করে ৷ সৈয়দ আশরাফুল হক, কাজী কামাল, ইব্রাহিম সাবের, রউফুল হাসান আর জুয়েল ৷ তাদের সঙ্গে সেও কখনও কখনও যায় মাঠে ৷ সারা দুপুর ক্রিকেট খেলে ৷ প্রায় প্রতিটা ইংরেজি ছবি দেখে ৷ মাঝে মধ্যে চলে যায় শিকার করতে ৷ সব হয়, শুধু স্কুলে যাওয়ার বেলায় তার দেখা নাই ৷
প্রথম প্রথম বহুদিন সে যায়নি ইস্কাটনের বাসায় ৷ মাসোহারার টাকা আনার জন্যে ওই বাসায় সে পাঠিয়ে দিত জায়েদকে ৷ তার বইপত্র আর কত সংগ্রহের জিনিসপাতি সবই তো পড়ে আছে ইস্কাটনের বাসায় ৷ কয়েক মাস পর থেকে সেসব আনতে মাঝে মধ্যে আজাদ যায় সেখানে ৷ দেখা হয় নতুন মায়ের সঙ্গে ৷
ভদ্রমহিলাও এক অদ্ভুত সংকটেই পড়েছেন ৷ ভালোবেসে, মোহগ্রস্ত হয়ে, দিওয়ানা হয়ে-যেভাবেই হোক আত্মসংবরণ করতে না পেরে তিনি ছুটে চলে এসেছেন চৌধুরীর ঘরে ৷ আগুনের টানে পতঙ্গ যে রকম ছুটে আসে, তেমনি করে চলে এসেছেন তাঁর অতীতকে অবলীলায় ত্যাগ করে ৷ এটাও কি একটা ত্যাগস্বীকার নয় ? কিন্তু এ বাড়িতে পরিবেশ তেমন অনুকূল নয় ৷ বাড়ির চাকর-বাকরেরা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না ৷ আত্মীয়স্বজনরা তাঁর দিকে কেমন রোষের দৃষ্টিতে তাকায় ৷ তিনি চান সবার চিত্ত জয় করতে ৷ কিন্তু সে চেষ্টা সুদূরপরাহত বলে মনে হয় ৷
আজাদ এ বাসায় এলে তিনি চেষ্টা করেন তাকে পটানোর ৷ বলেন, ‘কী খাবে ? কী লাগবে ? কিছু কিনে দেব ?’
আজাদ তাঁর কথার জবাব দেয় না ৷ গোঁ ধরে থাকে ৷ বেশি পীড়াপীড়ি করলে বাসা থেকে চলে যায় ৷
যেমন মা তেমনি ছেলের বাবা!
চৌধুরীর দ্বিতীয় বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় ফরাশগঞ্জের বাড়িতে একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে ৷ জায়েদের সে-সময়টা এখনও মনে আছে ৷ সে খুবই ছোট তখন ৷ বালক বয়স ৷ শেরে বাংলা ফজলুল হক মারা গেছেন ৷ সমস্ত প্রদেশে শোকের ছায়া ৷ এদিকে ফুটো পয়সা উঠে যাচ্ছে ৷ প্রবর্তিত হচ্ছে নয়া পয়সা ৷ জায়েদ নয়া পয়সার হিসাব শিখছে কাগজ-কলম নিয়ে ৷ কাগজে ফুটো পয়সা আর নয়া পয়সা গোল গোল করে এঁকে এঁকে তাকে শিখতে হচ্ছে ৬ পয়সায় এক আনা, ১২ পয়সায় দুই আনা, ৫০ পয়সায় আট আনা ৷ ১০০ পয়সায় এক টাকা ৷ এই হিসাবের ফেরে পড়ে একদিন সে মুশকিলেও পড়েছিল, তার মনে আছে ৷ আট আনা হলে হয় ৫০ পয়সা ৷ সে এক আনা এক আনা করে আট আনা জোগাড় করেছে ৷ একটা ৫ পয়সা আরেকটা ১ পয়সা মানে এক আনা ৷ এভাবে ৮ বার ৷ তাহলে তো আট আনাই হলো ৷ একটা সিনেমার টিকেটের দাম আট আনা ৷ কিন্তু সিনেমা হলে গিয়ে দেখা গেল পয়সা কম পড়ে গেছে ৷ কারণ একটা ১ পয়সা পকেটের কোন ফাঁক দিয়ে গেছে পড়ে ৷ আর ৬ পয়সা করে আট আনায় হয় ৪৮ পয়সা ৷ ১ পয়সা পড়ে যাওয়ায় তার কাছে আছে ৪৭ পয়সা ৷ হলের কাউন্টার ছিল ফাঁকা ৷ টিকেট বিক্রেতা বুড়োটা বলে, তিন পাইসা কম ৷ টিকেট নেহি মিলেগা ৷ ১ পয়সা কম কী করে তিন পাইসা কম হলো, জায়েদ বুঝতে পারে না ৷
ঠিক সেই সময় হঠাৎ বাসায় চিল্লাচিল্লি, জায়েদের মা মইরা যাইতেছে ৷
মা কেন মারা গেল, কীভাবে, জায়েদ সেই রহস্য আজো ভেদ করতে পারে না ৷ তবে তার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না, আজ তার মনে হয় ৷ তার বাবা আর চৌধুরী ছিলেন ভাই আর বন্ধু ৷ আর তার মা আর আজাদের মা ছিলেন বোন আর হরিহর আত্মা ৷ আজাদের মাকে বশীভূত করার জন্যে হয়তো কেউ প্রয়োজন মনে করেছিল তাঁকে একলা করে ফেলার ৷ হয়তো সে জন্যেই জায়েদের মাকে দুনিয়া থেকে চলে যেতে হয়েছে ৷ এ সবই আজ জায়েদের সন্দেহ হয় ৷ তখন সে ছিল অনেক ছোট ৷ বালক মাত্র ৷ কিছু বুঝতে পারেনি ৷ শুধু মনে আছে সে গিয়ে দেখতে পায় মা শুয়ে আছে আর তার শরীরটা সম্পূর্ণ নীল ৷ আর এরপর বহুদিন জায়েদ সবকিছুকে নীল দেখত ৷ তার মনে আছে, আম্মা মানে আজাদ দাদার মা নিজহাতে গোসল করালেন মাকে, কাফনের কাপড় পরালেন ৷ সেই কাফনের কাপড়টাকে পর্যন্ত নীল দেখাচ্ছে ৷ আগরবাতি জ্বলছে ৷ তা থেকে বেরুচ্ছে নীল রঙের ধোঁয়া ৷ ভাইবোনেরা, আত্মীয়স্বজন মহিলারা কাঁদছে ৷ কিন্তু আম্মা কাঁদছেন না ৷ তিনি কাফন পরানো শেষে কোরআন শরিফ নিয়ে বসলেন ৷ তাঁর এককোলে জায়েদের ১ মাস ৭ দিন বয়সের ছোট ভাই লিমন ৷ তারপর এক সময় মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে খাটিয়া তোলা হয় চারজনের কাঁধে ৷ জায়েদকেও বলা হয়, ‘বাবা, তোমার মা যাইতাছে, তুমিও একটু কাঁধ লাগাইবা নি ?’ সে তো তখন অন্য বাহকদের বুকসমান ৷ সে কী করে কাঁধ দেবে, সে কিছুই বুঝতে পারে না ৷ শুধু দেখতে পায় নীল রঙের খাটিয়ায় নীল কাফনে মোড়ানো তার মা যায় ৷
আজাদের মায়ের ঘাড়ে এসে পড়ে ছোট্ট লিমন আর জায়েদ, মহুয়া, চঞ্চল, কচি, টিসু-বোনের ছেলেমেয়েরা ৷ আর এদের বড় ভাই আজাদ ৷ জায়েদের বাবাও এই বাড়িতে আসা আর খোঁজখবর করা ছেড়ে দেন ৷ তিনিও অন্য কোথাও অন্য কোনো মধুকুঞ্জের সন্ধান পেয়ে গেছেন কিনা, জায়েদ ছিল ছোট, সে বুঝতে পারে না ৷ আজাদের মা কথা বলেন না, কিন্তু ছেলেমেয়েদের বুক দিয়ে আগলে রাখেন ৷
জায়েদের মা মারা যাওয়ার পর আজাদের মা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন, নিরবলম্বও ৷ কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েন না ৷ মচকানো তো দূরের কথা ৷
ইউনুস চৌধুরীর পক্ষ থেকে আবার মীমাংসার প্রস্তাব পাঠানো হয় সাফিয়া বেগমের কাছে ৷ তাঁকে সসম্মানে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, এ গ্যারান্টি দেওয়া হয় ৷ কিন্তু আজাদের মা রাজি হন না ৷ তাঁর জবান, এক জবান ৷ তিনি চৌধুরীকে তো আগেই বলে দিয়েছিলেন চৌধুরী যদি ওই বিয়ে করেন, তবে তাঁর মরা মুখটাও চৌধুরী দেখতে পাবেন না ৷ এই কথার কোনো নড়চড় তাঁর জীবদ্দশায় তো হবেই না, মৃত্যুর পরেও হবে না ৷ সাফিয়া বেগমের এ কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল ৷
চৌধুরী ক্ষিপ্ত হন ৷ সমস্তটা ঢাকা শহর তাঁর হাতের মুঠোয় ৷ তিনি ইচ্ছা করলে এই ঢাকা শহরটার যাকে ইচ্ছা তাকে কিনে ফেলতে পারেন ৷ প্রদেশের গভর্নর তাঁর বন্ধু, সেক্রেটারিরা তাঁর গেলাস-বান্ধব ৷ হুজ হু-তে তাঁর নাম উঠেছে: আ জমিনডার ফ্রম বিক্রমপুর ৷ আর কিনা একটা ছোটখাটো মহিলা তাঁর কথা শুনছে না ৷ এত জেদ! এত জেদ! এখন তো সার্বক্ষণিক পরামর্শদাত্রী কুটনি বোনটাও নাই ৷ তাহলে সে কেন আসে না ? চৌধুরীর পানাসক্তি আরো বেড়ে যায় ৷
আজাদের মা সাধারণত কথা বলেন না ৷ কিন্তু একদিন তিনি আজাদকে বলেন, ‘বাবা, কথা আছে, আয় ৷ বস ৷’
আজাদ মায়ের কাছে যায় ৷ বিছানায় বসে ৷
‘তুই নাকি স্কুল ছেড়ে দিয়েছিস ?’
আজাদ উত্তর দেয় না ৷
‘কাল থেকে আবার স্কুল যাবি ৷’
‘এখন আর যাওয়া যাবে না ৷ পরীক্ষা দেই নাই ৷ টিউশন ফি দেই না কয় মাস ৷ নাম কেটে দিয়েছে ৷’
‘তাহলে তুই কী করবি ? মূর্খ হয়ে থাকবি ?’
আজাদ চুপ করে থাকে ৷
মা বলেন, ‘তুই ছাড়া আমার আছে কে ? আমি তো মরেই যেতাম ৷ বেঁচে আছি কেন ? তোকে মানুষ করার জন্যে ৷ তুই যদি মানুষ না হবি, তাহলে আমি আর বাঁচি কেন ?’
আজাদ কেঁদে ফেলে ৷ আসলেই তার খুবই অনুশোচনা হচ্ছিল কদিন থেকে! কী করছে সে ? তার মনে পড়ে সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের অন্ধ পিয়ন পিটারকে ৷ স্কুলে আজও ঘন্টা বাজিয়ে চলেছে অন্ধ পিটার, হাত দুটো সামনে মেলে ধরে হাতড়ে হাতড়ে পথ হাঁটে যে পিটার, সেও তার কাজ ঠিকভাবে করে চলেছে, ওই তো এখনও ঘন্টাধ্বনি আসছে স্কুল থেকে, কত কষ্ট করেই না ঘন্টাটা দড়ি টেনে টেনে রোজ তোলে পিটার, অথচ সে কিনা চোখ থাকতেও পথ খুঁজে পাচ্ছে না ৷ পড়াশোনা বাদ দিয়ে কী করবে সে ?
সে বলে, ‘আমার ফ্রেন্ডদের সাথেই আমি মেট্রিক পাস করব ৷’
মা জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন করে ?’
‘প্রাইভেটে এই বছরই ম্যাট্রিক দিব ৷’
মার মুখে মৃদু একটা হাসি ফুটে ওঠে ৷
আজাদ মাকে কথা দিয়েছে, বন্ধুদের সঙ্গেই সে এই বছরে মেট্রিক পাস করবে ৷ এ-কথা তো তাকে এখন রাখতেই হবে ৷ আরপি সাহার স্কুল থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসাবে নাম তালিকাভুক্ত করায় সে ৷ তারপর ধুমসে পড়া শুরু করে ৷ বই কেনে ৷ টিউটর রাখে ৷ মা তাঁর সোনার গয়নার সঞ্চয় ভেঙে টিউটরের টাকা যোগাড় করেন ৷ বাবার মাসোহারা থেকেও তো টাকা ভালোই আসে ৷ আজাদের বন্ধুরা অবাক হয়ে যায় ৷ বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে পেয়ে যারা এতদিন তার কাছে ঘুরঘুর করত, তাদের সঙ্গ এখন আর ভালো লাগে না আজাদের ৷ তারাও পরিস্থিতি বুঝে বিকল্পের সন্ধানে কেটে পড়ে ৷ পরীক্ষার সময় নিকটবর্তী হয় ৷ একদিন আজাদ এসে কদমবুসি করে মাকে ৷ ‘মা, দোয়া করো ৷ টাঙ্গাইল যাচ্ছি ৷ পরীক্ষা শেষ করে তারপর আসব ৷’
মা ছেলের মাথায় হাত রাখেন ৷ তাঁর ছেলে ম্যাট্রিক দিচ্ছে ৷ এই দুঃখের দিনে এটা কত বড় আনন্দের সংবাদ ৷ তিনি ছেলেকে কাঁধে ধরে দাঁড় করিয়ে দেন ৷ ছেলের মাথায় হাত রাখেন ৷ বলেন, ‘আমার দোয়া তো আছেই ৷ ইনশাল্লাহ তুই ভালোভাবে পাস করবি ৷’
ছেলের মুখের দিকে একবার অলক্ষ্যে তাকান মা ৷ ছেলের নাকের নিচে গোঁফের রেখা ৷ কন্ঠস্বর ভাঙা ভাঙা ৷ মুখে একটা দুটো ব্রণ ৷ চুলে আবার একটুখানি টেড়ির লক্ষণ ৷ ছেলে তাঁর বড় হয়ে যাচ্ছে ৷ হোক! তাই-তো তিনি চান ৷ এই ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে এই পৃথিবীর বুকে দাঁড় করাতে পারলেই তাঁর সব কষ্টের অবসান হবে ৷ তিনি আল্লাহতায়ালার কাছে আর কিছু চান না ৷
‘কী মা, কী ভাবো ?’
ছেলের প্রশ্নে সংবিৎ ফিরে পান মা ৷ ‘আল্লাহ’ বলে একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন ৷ বলেন, ‘তোর কিছু লাগলে আমাকে বল ৷’
‘আমার আবার কী লাগবে ? যা লাগে সবই তো কিনেছি ৷ প্রাকটিক্যাল খাতা কিনলাম, টেস্ট পেপার কিনলাম ৷ বাদ তো রাখি নাকিছু ৷’
‘তুই ভালো করে পাস কর ৷ তোকে কমপ্লিট সু্যট বানিয়ে দেব ৷’
‘আরে, আমি কমপ্লিট দিয়া কী করব ?’ আজাদ হাসে ৷ মনে মনে খুশি হয় ৷ মায়ের মনোভাবটা সেও বোঝে, তারা এখন বাবার সাহায্য ছাড়া বেশ অর্থকষ্টের মধ্যে আছে, এটা তিনি বাইরের কাউকে বুঝতে দিতে চান না ৷ বাইরের লোকদের কাছে তারা মাথাটা উঁচু করেই রাখতে চায় ৷
আজাদ পাস করে সেকেন্ড ডিভিশনে ৷ রেজাল্টের দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল ৷ রেজাল্ট দেখার জন্যে তারা যায় বোর্ড অফিসে ৷ দেয়ালে রেজাল্ট শিট টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷ লোকজন ছাতা মাথায় তাই দেখছে ৷ তার সঙ্গে ফারুক নামের আরেকজন বন্ধু টাঙ্গাইল গিয়েছিল পরীক্ষা দিতে ৷ দুজনে দুরুদুরু বক্ষে গিয়ে একদৌড়ে দেয়ালের পাশে সারি সারি কালো ছাতাগুলোর নিচে ঢুকে পড়ে ৷ আজাদের খুবই ভয় লাগছিল ৷ নিজের জন্যে নয় ৷ মায়ের জন্যে ৷ যদি সে ফেইল করে, মা বড় আঘাত পাবেন ৷ এটা কেবল তার ম্যাট্রিক পাস করা বা ফেইল করার ব্যাপার নয়, মায়ের ব্যক্তিগত জেদের লড়াইয়ের প্রশ্ন ৷ সে ফেইল করলে তার বাবা কী হাসিটাই না হাসবে! মায়ের বুকে সেই বিদ্রূপটা কী ভয়ঙ্কর শেল হয়েই না বিদ্ধ হবে! কোথায় রোল তার ? থার্ড ডিভিশনের ঘর দেখে ৷ পাওয়া যায় না ৷ আজাদ খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ে! তার শ্বাস ঘন হয়ে ওঠে ৷ সে বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে থাকে ৷ এটা কি হতে পারে, সে ফেইল করবে ? জিওগ্রাফি এক্সামটা তত ভালো হয়নি, তাই বলে ফেইল ৷ শেষে মরিয়া হয়ে সে তাকায় সেকেন্ড ডিভিশনের ঘরে ৷ বিড়বিড় করে পড়ছে ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন, কোনো কিছু হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়ার দোয়া, ওই তো রোল নম্বর আরপি ৩৬৩৪ ৷ সেকেন্ড ডিভিশনের ঘরে ৷ ওহ্! মা! সে ছুটতে থাকে ৷ তার সঙ্গের বন্ধুটির রেজাল্ট কী তা না জেনেই ৷ তাকে সঙ্গে না নিয়েই ৷ বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে ৷
তার বন্ধুটি, ফারুক, এই কথা আর কোনো দিন ভুলতে পারবে না ৷
‘মা, মা, মা কোথায়, কয় তলায়, মা, কচি মা কোথায়, মহুয়া মা কোথায়, মা ৷’ আজাদ দৌড়ে যায়, মায়ের ঘরে মা নাই ৷ ‘কোথায় গেছে, ওজু করতে, কই ?’ ‘এই যে মা, আমার রেজাল্ট হয়েছে, আমি পাস করেছি, সেকেন্ড ডিভিশন’, আজাদ মাকে কদমবুসি করতে যায়, মা তাকে টেনে তোলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থাকেন, না, তাঁর চোখে হাসি ঝিলিক দেয় না, না তাঁর চোখে অশ্রু ঝরে না, তিনি নিজেকে সামলে নেন ৷ তিনি শান্তস্বরে বলেন, ‘তুই তো পাস করবি, তোর ব্রেন ভালো না!’
আজাদ বোকার মতো হাসে ৷ মা যে কী বলে! আরেকটু হলে তো গিয়েছিলই ৷
‘শোন, তুই এক কাজ কর, ১০ সের মিষ্টি কিনে আন ৷ মরণচাঁদ থেকে কিনিস, আজেবাজে মিষ্টি কিনবি না ৷’ তিনি তাঁর ড্রয়ারের কাছে যান ৷ টাকা বের করেন ৷ ‘মিষ্টি কিনে নিয়ে ইস্কাটন যাবি, তোর দাদির হাতে দিবি, দাদিকে সালাম করবি, দাদার হাতে দিবি, দাদাকে সালাম করবি ৷ বুঝিয়ে বলবি, কিসের মিষ্টি ৷’
আজাদ অবাক হয় ৷ সে ভাবতেও পারেনি, মা তাকে ইস্কাটন যেতে বলতে পারেন ৷
আজাদ মিষ্টির দোকানে যায় ৷ সঙ্গে জায়েদ ৷ মিষ্টির দোকানে বসেই জায়েদ কয়েক পদের মিষ্টি সাবাড় করে ৷ কয়েক সের মিষ্টি কেনে তারা ৷ মিষ্টির ঠোঙা নিয়ে তারা প্রথমে আসে ফরাশগঞ্জের বাসায় ৷ মাকে প্রথমে মিষ্টিমুখ করানো দরকার ৷ মা তো কোনো কিছু খেতেই চান না ৷ আমিষ খাওয়া ছেড়েছেন সেই যে ইস্কাটন ছাড়ার পর থেকে, আর ধরেননি ৷ ‘মা, একটু খাও ৷ এই বাসার জন্যে একটু মিষ্টি কিনলাম ৷ বুঝলা না, ওই বাসার আগে তো এই বাসার লোকদের মিষ্টিমুখ করানো দরকার ৷’
মা মিষ্টি দেখে মুখ সরিয়ে নেন ৷ ‘না রে, খেতে ইচ্ছা করে না ৷’
‘অল্প খাও ৷ অল্প ৷’ আজাদ নাছোড় ৷
মা একটুখানি মিষ্টি মুখে দেন ৷ বলেন, ‘এই দুটো ঠোঙা রেখে দে ৷ পাড়াপড়শিদের দিতে হবে ৷ ভালো খবর ৷ সবাই জানুক ৷ আর এখানে কত ?’
‘১০ সের’-হাতের মিষ্টির রস চাটতে চাটতে জায়েদ জবাব দেয় ৷
‘এগুলো নিয়ে ইস্কাটনে যা ৷ আজকে সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলবি ৷ আজকে আমাদের হাসার দিন’-মা বলেন ৷
১০ সের মিষ্টি নিয়ে আজাদ ইস্কাটনের বাসার সামনে নামে ৷ কত দিন পর এ বাড়িতে আসা হলো তার ৷ এটা যে তাদের বাড়ি, অনভ্যাসে সেটা মনেও হয়নি এ কদিন ৷ আশ্চর্য ৷ না, সে হরিণগুলোর দিকে তাকাবে না, রাজহাঁসগুলোর দিকে না, তার স্প্যানিয়েল ডগ টমির দিকে না ৷
সে সোজা দাদা-দাদির ঘরে যায় ৷ দাদির সামনে মিষ্টির প্যাকেটগুলো রাখে ৷ দাদিকে সালাম করে ৷ ‘আমি ম্যাট্রিক পাস করেছি ৷ তার মিষ্টি রেখে গেলাম ৷’
‘এতগুলা মিষ্টি আনা লাগে ৷ খালি টাকা খরচ’-দাদি বলেন ৷
‘আর নাই তো ৷ রেজাল্ট হয়েছে তো, সবাই মিষ্টির দোকানে ভিড় করছে ৷ যা পেয়েছি এনে দিলাম ৷ কম হলে বলো ৷ কালকে আরো এনে দেব ৷’
‘দুরো আভাগা ৷ আমি কী কই, হে কী বুঝে ৷’
বাসার বাবুর্চি, কাজের লোক, পরিচারিকারা সবাই আড়ালে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে ঘটনাটা ৷ আজকে কেন ভাইয়া এতদিন পরে এ বাড়িতে এল ৷ তাহলে কি বেগম সাহেবা ফিরে আসবেন আবার ?
তারা উঁকিঝুঁকি দিয়ে ঘটনার তাৎপর্য বুঝে ফেলে ৷ ছোট সাহেবে মেট্রিক পাস দিছে ৷
ছোটমায়ের কাছে খবর যায় ৷ ছোট সাহেবে আসছে ৷ মিষ্টি আনছে মেলা ৷ উনি ম্যাট্রিক পাস দিছে ৷
বেরিয়ে যাওয়ার পথে ছোটমায়ের সাঙ্গে দেখা হয় আজাদের ৷ তিনি হাসিমুখে বলেন, ‘বাবা, তুমি পাস করেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি ৷ বসো ৷ একটু মিষ্টি খেয়ে যাও ৷’
আজাদ তাঁকে আগে থেকেই চেনে ৷ বড়মা বলে তাঁর কাছ থেকে আগে আদরও নিয়েছে ৷ আজকে তার কেমন যেন লাগে ৷ কিন্তু তার মনে হয়, মা যে আজকে এ বাড়িতে মিষ্টি দিয়ে পাঠিয়েছেন, এ তো তার বিজয় উদযাপন করবার জন্যেই ৷ অসুবিধা কী ছোটমার কথা শুনতে!
আজাদ বসে ৷ ছোটমা বলেন, ‘তুমি কোনদিকে যাবা এখন ?’
‘এই তো গুলিস্তানের দিকে ৷’
‘আমিও ওই দিকে যাচ্ছি ৷ তুমি আমার সাথে চলো ৷’
‘না, আমি একলাই যেতে পারব ৷’
‘আরে না, চলো তো ৷’
ছোটমা গাড়ি বের করেন ৷ নিজেই তিনি ড্রাইভ করছেন ৷ আজাদকে পাশে বসান ৷ মহিলার পাশে বসে তার নিজেকে সিনেমায় দেখা কোনো চরিত্র বলে মনে হয় ৷ ঢাকার রাস্তায় মহিলারা সাধারণত গাড়ি চালায় না ৷ ইনি চালাচ্ছেন ৷ দুপাশের লোকেরা বেশ কৌতূহল নিয়েই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ ছোটমা গুলিস্তানের আগে বিজয়নগরের ভোগ দোকানের সামনে গাড়ি থামান ৷ বলেন, ‘আসো ৷ তুমি না লংপ্লে পছন্দ করো ৷ তোমাকে লংপ্লে কিনে দেই ৷’
‘না, লাগবে না ৷’
‘আরে আসো তো ৷’
আজাদ ভাবে, ছোটমাকে জব্দ করব ৷ যত এলভিস প্রিসলি আছে, সব কিনব ৷ দেখি কী করে ৷
দোকানে ঢুকে একটার পর একটা এলভিস প্রিসলি নামাতে থাকে আজাদ ৷ দু হাত ভরে যায় ৷ দোকানদাররা বিস্মিত ৷ ছোট মা অবিচলিত ৷ ‘কত দাম এসেছে ?’
দোকানি দাম হিসাব কষতে গিয়ে গলদঘর্ম ৷ দেড় হাজার রুপিয়া বেগম সাব ৷
ছোটমা ব্যাগ থেকে চেক বের করে খসখস করে সিগনেচার করে দেন ৷
আজাদ মনে মনে খুশি হয় ৷ এই রেকর্ডগুলো তার খুব প্রিয় ৷ এগুলো সে অনেকবার জোগাড় করতে চেয়েছে ৷ শুধু জায়েদকে দিয়ে ও বাসা থেকে তার নিজের রেকর্ড প্লেয়ারটা আনিয়ে নিতে হবে ৷ তবে মাকে এ ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না ৷ ব্যাপারটা স্ট্রেইট চেপে যেতে হবে ৷