মা হওয়ার পর মেয়েদের আর সৌন্দর্য, ফিগার বা চেহারার গুরুত্ব নিয়ে ভাবার দরকার নেই-এ ধারণাও আজ সেকেলে হয়ে গেছে। বরং ভাবুন, এই মা হওয়ার ঘটনাটি আপনার জীবনকে আরো সুন্দর, পরিপূর্ণ এবং উজ্জ্বল করে তুলছে। আপনার নারীত্বের দ্যুতি ও সৌন্দর্যকে তা বাড়িয়ে তুলছে অনেক গুণ। মা হওয়ার পর মায়ের শারীরিক কিছু পরিবর্তন ঘটে। এ অবস্থা থেকে স্বাভাবিক হতে যা করা যেতে পারে
পূর্বাবস্থায় ফিরে আসুন ধীরে ধীরে
গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের নয় মাসে স্বাভাবিকভাবে প্রায় ১০ থেকে ১২ কেজি ওজন বৃদ্ধি পান। কারো কারো ক্ষেত্রে পারিবারিক, হরমোনাল বা পানির আধিক্যের জন্য এই ওজন আরও বেশি হতে পারে। অনেক নারীই ভাবেন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বোধকরি আগের ওজনে ফিরে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু ভাবুন, এই ওজন আপনি অর্জন করেছেন দীর্ঘ নয় মাসে। নয় দিনে কি তা কমানো সম্ভব? কাজেই ধৈর্য ধরতে হবে। প্রসব-পরবর্তী শারীরিক অবস্থার প্রত্যাবর্তন-প্রক্রিয়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ইনভোলিউশন।
এ সময় নারীর ফুলে-ফেঁপে ওঠা জরায়ু ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসে। তলপেটের ঢিলে হয়ে পড়া ত্বক, পেশি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ধীরে ধীরে আগের মতো হতে থাকে। প্রসবের পর প্রথম তিন মাসে ঘটে এই ইনভোলিউশন। কিন্তু স্কীত পেট, শরীরের অতিরিক্ত মেদ ও ওজন পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরে আসতে আসলে আরও সময় লেগে যায়। কারো কারো হয়তো পুরোপুরি আসেও না। বিশেষ করে যারা নবজাতককে নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ততায় নিজের প্রতি সচেতন হওয়ার সময় পান না বা আগ্রহবোধ করেন না।
এ বিষয়ে বিশেষঞ্জ চিকিৎসকের অভিমত, প্রসব-পরবর্তী সময়ে যেহেতু মা শিশুকে স্তন্যপান করাবেন, সেহেতু তার খুব বেশি খাদ্য নিয়ন্ত্রণ (ডায়েট কন্ট্রোল) করা উচিত নয়। কেননা, এ সময় একজন নারীর স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে প্রায় ১০০০ থেকে ১৫০০ ক্যালরি বেশি পুষ্টি প্রয়োজন। তবে চেষ্টা করুন এই অতিরিক্ত ক্যালরি যেন মূলত আসে প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজযুক্ত খাদ্য থেকে। উল্টো দিকে চর্বি ও শর্করাজাতীয় খাদ্য খাবেন পরিমিত। সে কারণেই ভাত-রুটি, আলু-মাংসের পরিমাণ কমিয়ে প্রতিদিনের খাবারে প্রচুর পরিমাণে মাছ, বিশেষ করে কাঁটাযুক্ত ছোট মাছ, শাকসবজি, সালাদ, ফলমূল, ফলের রস রাখবেন।
ব্রেস্ট ফিডিং বা স্তন্যপান করানোর মাধ্যমে মা প্রতিদিন প্রচুর ক্যালরি খরচ করেন। সত্যিকার অর্থে ব্রেস্ট ফিডিং-ই হচ্ছে মায়ের ওজন কমানোর সবচেয়ে প্রথম ও ভালো পদ্ধতি। স্তনের আকার নষ্ট হয়ে যাবে বলে বা ঝামেলা এড়ানোর জন্য যে নারী ব্রেস্ট ফিডিং করতে চান না, তার চেয়ে বোকা এবং দুর্ভাগা আর কেউ নেই। কেননা, ব্রেস্ট ফিডিং শুধু শিশুর জন্যই যে দরকারি তা নয়, মায়ের হরমোনাল ও মানসিক-শারীরিক পরিবর্তনের জন্যও এটি সহায়ক।
নরমাল ডেলিভারি হলে অন্তত দেড় মাস এবং সিজারিয়ান হলে অন্তত তিন থেকে ছয় মাস কোনো প্রকার ভারী ব্যায়াম না করাই উচিত। কিন্তু প্রতিদিন হাঁটা এবং হালকা ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করাটাকে ইদানীং চিকিৎসকেরা উৎসাহই দিয়ে থাকেন। এই হাঁটাহাঁটি শুরু করা যায় একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েই। আর ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ অন্তত ছয় সপ্তাহ পরে। তলপেটের চামড়া, পেশি ও অঙ্গগুলোকে পুনরায় টাইট করার জন্য পেলভিক এক্সারসাইজও শুরু করতে হবে একেবারে প্রথম থেকে।
ছয় মাস পর থেকে কেউ চাইলে জিমে গিয়ে পেটের ভারী এক্সারসাইজ, অ্যারোবিকস বা ইনস্ট্রুমেন্টাল এক্সারসাইজ করতে পারেন। জিমগুলোয় পেট কমানোর আলাদা ব্যায়াম করার ব্যবস্থা আছে অথবা তা শিখে নিয়ে করতে পারেন ঘরে বসেই।
প্রসব-পরবর্তী সময়ে পেট কমানোর জন্য বাজারে যেসব বেল্ট পাওয়া যায়, আদতে এর কোনো কার্যকারিতা নেই।
সবচেয়ে বড় কথা, আগের অবস্থায় ফিরে যেতে ধৈর্য ধরুন। অকারণে ডায়েট করে শিশুকে প্রয়োজনীয় ক্যালরি থেকে বঞ্চিত করবেন না; নিজেরও হাড়ক্ষয়, ভিটামিনের অভাব, রক্তশূন্যতা সৃষ্টি করবেন না। পর্যাপ্ত ও সুষম খাবার খান এবং প্রাথমিক অবস্থায় কেবল হাঁটুন।
যত্ন নিন শরীর ও সৌন্দর্যের
হরমোনগত পরিবর্তনের কারণেই গর্ভাবস্থায় ঘটে আরো কিছু পরিবর্তন। যেমন-ত্বক, গাল ও ঘাড়ে কালো দাগ পড়ে, যাকে বলে ক্লোঅ্যাজমা। পেট প্রসারিত হওয়ায় ত্বকের ইলাস্টিসিটি নষ্ট হয়ে ফাটা দাগ বা স্ট্রেচ মার্ক পড়ে, কারো কারো খুব বেশি অবাঞ্ছিত লোম গজায়, কারও প্রসবের পর প্রচুর পরিমাণে চুল পড়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রসব-পরবর্তী সময়ে এসব সমস্যা এমনিতেই মিলিয়ে যায়, চিকিৎসকরা বলে থাকেন।
প্রসব ও এর পরবর্তী সময় প্রচুর পানি পান এবং তাজা ফল ও সবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন। কেননা এতে ত্বক ও চুল ভালো থাকবে।
সূর্যালোকে গেলে ভালো মানের সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে
প্রচুর বিশ্রাম নিতে হবে। নবজাতকের জন্য সব সময় তা সম্ভব না হলেও ঘুমের সময় বের করে নিজের মতো বিশ্রাম নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় পেটের আকার প্রসারিত হওয়ার সময় ভালো ময়েশ্চারাইজার নিয়মিত ব্যবহার করলে পেটে বেশি স্ট্রেচমার্ক পড়ে না। এ ছাড়া প্রসবের পর ব্যবহার করা যায় অ্যান্টি-স্ট্রেচমার্ক ক্রিম।
প্রসবের ছয় মাস পর শরীরে অবাঞ্ছিত চুল এমনিতেই কমে যায়। তবু কেউ চাইলে সন্তান জন্মের পর ওয়েক্সিং, থ্রেডিং বা টুইজিং করাতে পারেন।
শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের আধিক্যের কারণে গর্ভাবস্থায় নারীর চুল ঘন ও বড় হয়ে ওঠে। আবার প্রসবের পর হরমোনের প্রভাব কমে যাওয়ায় চুল পড়তে শুরু করে। এটিও একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ জন্য চুলের স্বাভাবিক যত্ন নিতে হবে।সুষম খাবার খেতে হবে। ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই, বায়োটিন, আইনোসিটল, জিংক এবং কো-এনজাইম কিউ-১০ চুলের উপকারী বন্ধু। এ সময় হেয়ার ড্রায়ার, কার্লিং আয়রন, হট রোলার ব্যবহার না করাই ভালো। গর্ভকালীন ও স্তন্যপানকালে কালার, স্ট্রেইটনিং, রিবন্ডিং করাবেন না। চুল পরিষ্কার রাখুন, বড় দাঁত বা ব্রাশওয়ালা চিরুনি ব্যবহার করুন। মাসে দু-একবার প্রোটিন হেয়ার ট্রিটমেন্ট করাতে পারেন।
ফিগার ঠিক করার জন্য দেড় থেকে তিন মাস পর ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ শুরু করতে হবে। তিন-চার সপ্তাহ পর থেকেই নিয়মিত হাঁটতে শুরু করে দিতে হবে। প্রয়োজন মনে করলে ছয় মাস পর জিমে যাওয়া যেতে পারে। তবে ওজন কমাতে এবং স্লিম হতে সময় ধৈর্য ধরতে হবে। নিজের ও শিশুর স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে এমন কিছু করা যাবে না।
মাতৃত্বকে উপভোগ করুন
শিগগিরই মা হতে যাচ্ছেন যে নারী অথবা সম্প্রতি মা হয়েছেন যে নারী-এ লেখাটি তাদের জন্য। একবার আয়নার সামনে দাঁড়ান, নিজেকে পূর্ণ চোখ মেলে দেখুন। দেখুন, ত্বকের কালো দাগ, লোম, ডার্ক সার্কেল ভারী পা বা বেঢপ পেট নয়-দেখুন, এসব মিলিয়ে মাতৃত্বের এক অভাবনীয় সৌন্দর্য, যা আপনি নিজের মধ্যে আর কখনো দেখেননি। উপভোগ করুন এ সৌন্দর্য। আপনার স্বামী, আপনার পরিবার, বন্ধুবান্ধব-সবাইকে এই সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন ও অবহিত করুন। সুস্থ থাকুন, হাসি-খুশি থাকুন। প্রাণবন্ত ও উচ্ছ্বসিত থাকুন। পৃথিবী মুগ্ধ হবে আপনাকে দেখে। বিশ্ব সুন্দর হয়ে উঠবে আপনার সৌন্দর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। সমস্ত জগৎ আলোকিত হয়ে হেসে উঠবে আপনাকে ও আপনার কোলে শিশুকে হাসতে দেখে।