শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪ ১৭ই কার্তিক ১৪৩১
Smoking
 
সীমান্তবর্তী গ্রামে রোহিঙ্গাদের রাখছে স্থানীয়রা
প্রকাশ: ১০:৩৭ am ১২-০৯-২০১৭ হালনাগাদ: ১০:৪০ am ১২-০৯-২০১৭
 
 
 


কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের হোয়াইক্যং বাজার থেকে পশ্চিম দিকে মাত্র দুই মিনিট হেঁটে যাওয়া যায় আন্ধারিপাড়া গ্রামে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত থেকে এ গ্রামের দূরত্ব দেড় কিলোমিটারেরও কম। সেখানে অনেক বাড়িতে এখন রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। তাদের কেউ বিনা পয়সায়, কেউ মাসিক ভাড়ায় থাকছে। কিছু রোহিঙ্গা জমি কিনে ঘর নির্মাণের কাজও শুরু করেছে।
দুপুরে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, গ্রামের নজির আহমদের বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় দুটি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। বাঁশের খুঁটি ও চালার অককাঠামো তৈরির কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সেখানে মাটি সমতল করার কাজ করছিলেন মিয়ানমারের মংডুর হাসুরাতা গ্রাম থেকে আসা রহিম উল্লাহ (৫৫)। এ সময় পাশেই ছিলেন তার স্ত্রী জহুরা বেগম (৫০) ও মেয়ে হাজেরা বেগম (২৫)। রহিম উল্লাহ জানান, তার নিকটাত্মীয় নজির আহমদের (যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন) কাছ থেকে এক টুকরো জমি কিনেছেন। সেখানেই ছোট একটি ঘর নির্মাণ করছেন তিনি। ছয় দিন আগে তার পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশে আসে। এরপর তিনি উখিয়ার বালুখালীতে সম্প্রতি গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে জায়গা খুঁজেছেন। জায়গা না পাওয়ায় চলে আসেন আন্ধারিপাড়া গ্রামে।

তিনি আরও জানান, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তার গ্রামে হানা দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এ অবস্থায় পালানোর চেষ্টাকালে তার ছেলে এনায়েত উল্লাহকে (১৮) গুলি ও জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। এ সময় পরিবারে অন্য সদস্যরা দিগ্বিদিক ছুটে পালিয়ে এসেছে।

মেয়ে হাজেরা খাতুন জানান, পালিয়ে আসার সময় নৌকা থেকে পড়ে তার চার বছর বয়সী মেয়ে রিশমা নিখোঁজ হয়েছে। ডুবে যাওয়ার পর নাফ নদীতে তাকে ফেলেই চলে আসেন তারা। মনে ভয় ছিল, কখন মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ এসে গুলি করে। স্বামী ইসমাঈল কোথায় তিনি জানেন না। বাপের বাড়িতে ছিলেন বলে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছেন তিনি। এখন তার স্বামীর মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। হাজেরার দুই বছর ও ছয় মাস বয়সী আরও দুটি মেয়ে রয়েছে। তারা তার কাছেই আছে। পাশেই ছোট জায়গায় আরেকটি বাড়ি নির্মাণ করছেন মংডুর আইজ্জারপাড়া থেকে আসা নজির আহমদ (৫০)। আট ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তিনি ছয় দিন আগে পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে। কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে পরিচিত নজির আহমদের বাড়িতে এসেছেন। তার উঠানেই ছোট একটি ঘর নির্মাণ করছেন। ঘর নির্মাণের জন্য জমির মালিককে কোনো টাকা দিতে পারেননি বলে জানান তিনি। তবে মাসিক এক হাজার টাকা করে ভাড়া দেবেন। এ গ্রামের পাহাড়ের টিলায় খোরশেদ আলমের বাড়ি। ওই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে দুটি পরিবার। তাদেরই একজন তসকিয়া (৪০)। তার স্বামীর নাম মো. ওসমান। বাড়ি মংডুর বলিবাজারের মৌলভীর জায়গা গ্রামে। এক সপ্তাহ আগে ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতিসহ তারা আটজন পালিয়ে এসেছে। সাময়িকের জন্য আশ্রয় নিয়েছে এ বাড়িতে। বালুখালী বা অন্য কোথাও থাকার জায়গা পেলে তারা চলে যাবেন। এ বাড়িতে থাকার জন্য তাদের কোনো টাকা দিতে হচ্ছে না বলেও জানান তসকিয়া। তবে এলাকার লোকজন জানিয়েছে, তসকিয়ারা মাসিক এক হাজার টাকা ভাড়া দেওয়ার শর্তে ওই বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে। তাদের মতো এ গ্রামে স্থানীয় লোকজনের বাড়িতে ভাড়ার চুক্তিতে আছে আরও কিছু পরিবার। পাহাড়ের আরেক টিলায় স্থানীয় বাসিন্দা শাহ আলমের বাড়ি। ওই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে মংডুর বলিবাজারের মৌলভীর জায়গা থেকে আসা শামসুন্নাহার, তার স্বামী নুরুল ইসলাম এবং তাদের তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়েসহ পরিবারের ১০ সদস্য। কোরবানির ঈদের আগের দিন এলাকায় সেনাবাহিনী হানা দিলে তারা পালিয়ে আসে। বাড়ির মালিক শাহ আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওরা রাস্তার পাশে অসহায় অবস্থায় পড়ে ছিল। মানবিক কারণে আমি তাদের ডেকে এনে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছি। কোনো টাকা-পয়সা নেইনি। তারা নিজেরাও এনে খাচ্ছে, আমরাও যেভাবে পারি সহযোগিতা করছি। স্থানীয় বাসিন্দা মো. মামুন বলেন, এ গ্রামে স্থানীয় লোকজনের বাড়িতে অনেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। কেউ মানবিকতার খাতিরে, কেউ মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে তাদের বাড়িতে রেখেছেন। এভাবে থাকলে রোহিঙ্গারা সমাজের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। শুধু আন্ধারিপাড়া গ্রামে নয়, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে অনেক রোহিঙ্গা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অনেকেই স্থানীয় লোকজনের বাড়িতে ভাড়ায় থাকছে। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের লম্বাবিল, উলুবনিয়া, তুলাতলী গ্রামে অনেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

লম্বাবিল গ্রামের বাসিন্দা শহীদ উল্লাহ বলেন, আমার বাড়িতে পাঁচটি রোহিঙ্গা পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। মানবিকতার খাতিরে তাদের থাকতে দিয়েছি। আমরা যতটুকু পারছি খাবার দিয়েও তাদের সহায়তা করছি। স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এ গ্রামের রফিকুল ইসলামের বাড়িতে চারটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা। তাদের কাছ থেকে একটি কক্ষের জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে ভাড়া নেওয়া হবে প্রতিমাসে। এছাড়াও সীমান্তবর্তী তুলাতলী গ্রামের বাসিন্দা আবদুস সালাম, নজির আহমদ, কবির আহমদ ও ইলিয়াসের বাড়িতে, উলুবনিয়া গ্রামের মনিরুল ইসলাম, হাফেজ আহমদ, নুরুল আমিন ও রফিকের বাড়িতে রোহিঙ্গা অনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।    আওয়ামী মত্স্যজীবী লীগ টেকনাফ উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দীন চৌধুরী বলেন, টেকনাফের নাফ নদী পার হয়ে প্রতিদিন রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। তাদের অনেকেই বাংলাদেশি লোকজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। পরিচয় লুকিয়ে আত্মগোপন করছে। বাড়ি ভাড়া নিয়েও অনেকে থাকছে। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। অনুপ্রবেশকারী সব রোহিঙ্গাকে এক স্থানে রাখা না গেলে ভয়াবহ পরিণতি হবে। তারা মিশে যাবে সমাজের স্রোতে। কক্সবাজার সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি গিয়াস উদ্দীন বলেন, বাংলাদেশি নাগরিকরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মানে খাল কেটে কুমির আনার মতোই। এতে তারা সমাজের স্রোতে মিশে যাওয়ার সুযোগ পাবে। তাদের নির্দিষ্ট স্থানে রাখা জরুরি। ‘রোহিঙ্গা সেল’-এর মুখপাত্র ও কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ বলেন, সম্প্রতি অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের জন্য উখিয়ায় জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন অনুপ্রবেশ করা সব রোহিঙ্গাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। রোহিঙ্গারা যাতে অন্যত্র ছড়িয়ে যেতে না পারে তার জন্য পুরোদমে কাজ করছে স্থানীয় প্রশাসন। তাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছে।

ছবিঃ শামীম আহম্মেদ

 
 

আরও খবর

Daraz
 
 
 
 
 
 
 
 
©ambalanews24.com | Developed & Maintenance by AmbalaIT