ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে অলিখিত লড়াইয়ে অনেক এগিয়ে থেকে জিতলেন লিওনেল মেসি। আর্জেন্টিনার এই তারকা ফরোয়ার্ডের চোখ-ধাঁধানো নৈপুণ্যে রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে অবিস্মরণীয় এক জয়ে লা লিগার শিরোপা লড়াই জমিয়ে তুললো বার্সেলোনাও।
সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ে রোববার রাতে রোমাঞ্চকর এই এল ক্লাসিকো ৩-২ গোলে জিতেছে বার্সেলোনা। লা লিগার শেষ দিকে এসে দুই দলের পয়েন্টই এখন ৭৫। তবে মুখোমুখি লড়াইয়ে এগিয়ে শীর্ষে উঠলো এক ম্যাচ বেশি খেলা কাতালান ক্লাবটি।
প্রথমার্ধে কাসেমিরোর গোলে পিছিয়ে পড়ার পর সমতা ফেরাতে দেরি করেননি ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুর্দান্ত খেলা মেসি। দ্বিতীয়ার্ধে ইভান রাকিতিচের দর্শনীয় গোলে অতিথিরা এগিয়ে যাওয়ার পর সমতা ফিরিয়েছিলেন হামেস রদ্রিগেস। যোগ করা সময়ে দুর্দান্ত শটে মূল্যবান ৩ পয়েন্ট এনে দেন মেসি। একই সঙ্গে স্পর্শ করেন বার্সেলোনার জার্সিতে ৫০০তম গোলের অনন্য মাইলফলক।
বর্ষসেরা ফুটবলারের লড়াইয়ে প্রায় এক দশক ধরে মেসির প্রতিদ্বন্দ্বী রোনালদো ছিলেন নিষ্প্রভ। তার সতীর্থ কেইলর নাভাস দারুণ কিছু সেভ না করলে বড় ব্যবধানে হারতে হতো স্বাগতিকদের। অপর প্রান্তে গোলপোস্টের নীচে দুর্দান্ত ছিলেন মার্ক-আন্ড্রে টের স্টেগেনও।
ম্যাচের শুরুতে বার্সেলোনাকে স্বাগতিকরা চেপে ধরার পর ষষ্ঠ মিনিটে ডি-বক্সের একটু বাইরে থেকে ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর শট ফেরাতে তেমন সমস্যা হয়নি টের-স্টেগেনের।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বলের দখলও ফিরে পায় বার্সেলোনা। একাদশ মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে লুইস সুয়ারেসের নীচু শট পোস্টের বাইরে দিয়ে যায়।
১৮তম মিনিটে পাল্টা আক্রমণে ডি-বক্সের ভেতর থেকে করিম বেনজেমার শট ঠেকান টের স্টেগেন। দুই মিনিট পর রোনালদোর শট বাঁয়ে ঝাঁপিয়ে এক হাতে ঠেকান জার্মান এই গোলরক্ষক।
২৮তম মিনিটে ম্যাচের প্রথম কর্নার থেকেই গোল পায় স্বাগতিকরা। বল পুরোপুরি বিপদমুক্ত করতে পারেনি বার্সেলোনা। ডি-বক্সের বাইরে থেকে মার্সেলোর উঁচু করে বাড়ানো বলে সের্হিও রামোসের ভলি পোস্টে লেগে ফিরলে অপর পোস্টের পাশ দিয়ে তা ফাঁকা জালে পাঠান কাসেমিরো।
ম্যাচের ২০ মিনিটের দিকে ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার মার্সেলোর কনুইয়ের আঘাতে মুখ থেকে রক্ত বের হওয়ার পর ঠোটের নীচে টিস্যু পুরে প্রথমার্ধের বাকি সময়টা খেলা মেসির দুর্দান্ত পায়ের কাজে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সমতায় ফিরে বার্সেলোনা।
সের্হিও বুসকেতসের বাড়ানো বল থেকে রাকিতিচের পাস বাঁ পায়ে ধরে ডি-বক্সে ঢুকে ডান পায়ে কারভাহালের কাছ থেকে বল সরিয়ে আবার বাঁ পায়ে নাভাসের হাতের নীচ দিয়ে জালে জড়িয়ে দেন মেসি।
এরই সঙ্গে লা লিগায় হওয়া ক্লাসিকোতে সর্বোচ্চ ১৫টি গোল করে রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি আলফ্রেদো দি স্তেফানোকে ছাড়িয়ে রেকর্ড একার করে নিলেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক।৩৬তম মিনিটে মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচের দূরপাল্লার শট ঠেকিয়ে রিয়ালকে আবার এগিয়ে যেতে দেননি টের স্টেগেন।
৪৩তম মিনিটে ডান দিক থেকে সুয়ারেসের দারুণ ক্রসে জর্দি আলবার ভলি পোস্টের বাইরে দিয়ে যায়। বিরতির ঠিক আগে কর্নার থেকে নাভাস বলের ফ্লাইট বুঝতে ভুল করায় পোস্টের খুব কাছে বল পেয়েছিলেন মেসি, কিন্তু শট লক্ষ্যে রাখতে পারেননি।
প্রথমার্ধের মতো দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই চেপে বসে রিয়াল। কারভাহালের ক্রস কর্নারের বিনিময়ে বিপদমুক্ত করেন পিকে। একটু পরেই স্বদেশি টনি ক্রুসের শট ডানে ঝাঁপিয়ে ঠেকাতে হয় টের স্টেগেনকে। তবে আবার কর্তৃত্ব নিতে দেরি হয়নি লুইস এনরিকের দলের।
৫৩তম মিনিটে মার্সেলোর ক্রসে খুব কাছ থেকে নেওয়া বেনজেমার হেড দারুণ রিফ্লেক্স দেখিয়ে সেভ করেন টের স্টেগেন। তিন মিনিট পর রাকিতিচের ফ্লিকে ডি-বক্সে বল পেয়ে নাভাসকে ফাঁকি দিতে পারেননি নিষিদ্ধ থাকা নেইমারের বদলে খেলতে নামা পাকো আলকাসের। ৫৯তম মিনিটে কর্নার থেকে জেরার্দ পিকের জোরালো হেড গোললাইনে ঝাঁপিয়ে ঠেকিয়ে আবারও রিয়ালের ত্রাতা নাভাস।
প্রথমার্ধেই ধুঁকতে থাকা বেলের বদলে খেলতে নামা মার্কো আসেনসিও ৬৭তম মিনিটে ডান দিক থেকে বল নিয়ে এগিয়ে রোনালদোকে বাড়িয়েছিলেন দারুণ এক ক্রস। কিন্তু কাছ থেকে অবিশ্বাস্য ব্যর্থতায় ক্রসবারের উপর দিয়ে বল পাঠান পর্তুগিজ এই ফরোয়ার্ড।পরের মিনিটে ইনিয়েস্তার বাড়ানো বলে কাছ থেকে উরুগুয়ের স্ট্রাইকার সুয়ারেসের জোরালো হাফভলি ফিরিয়ে আবারও রিয়ালকে বাঁচান নাভাস।
৭৩তম মিনিটে রাকিতিচকে আর ঠেকাতে পারেননি। ডি-বক্সের বাইরে থেকে ডান পায়ে শট মারার ডামি করে টনি ক্রুসকে ধোঁকা দিয়ে বাঁ পায়ের বাঁকানো শটে রামোস আর নাচো ফের্নান্দেসের মাঝ দিয়ে বা পোস্ট দিয়ে বল জালে পাঠান ক্রোয়েশিয়ার এই মিডফিল্ডার।চার মিনিট পরই অহেতুক মেসিকে ফাউল করে অধিনায়ক রামোস লালকার্ড দেখলে ১০ জনের দলে পরিণত হয় রিয়াল।
৮০তম মিনিটে আন্দ্রে গোমেসের ক্রসে পিকের শট অসাধারণ দক্ষতায় ঠেকিয়ে রিয়ালকে লড়াইয়ে রাখেন নাভাস। তিন মিনিট পর কোস্টা রিকার এই গোলরক্ষক মেসির শট ঠেকিয়ে আবারও রক্ষাকর্তা।
৮৬তম মিনিটে মার্সেলোর ক্রস থেকে চার মিনিট আগে বদলি হিসেবে নামা হামেস রদ্রিগেসের গোলে সমতা ফেরায় রিয়াল। কিন্তু মেসি জাদুর তখনও আরও বাকি। দুই মিনিট যোগ করা সময়ের শেষ মিনিটে জর্দি আলবার ক্রসে ডি-বক্সের একটু ভেতর থেকে বাঁকানো শটে নাভাসকে ফাঁকি দিয়ে ঠিকই এনে দেন অবিশ্বাস্য এক জয়।
এবারের লা লিগার মেসির ৩১তম গোলটি বার্সেলোনার জার্সিতে সব মিলিয়ে ৫০০তম। অবিস্মরণীয় এই গোলের পর গর্বের জার্সি খুলে রেফারির হলুদ কার্ডে ভ্রুক্ষেপ না দেখিয়ে স্তব্ধ গ্যালারির দিকে তুলে ধরেন পাঁচবারের বর্ষসেরা এই ফুটবলার।
মেসি বার্সেলোনকে সান্তিয়াগো বের্নাবেউ থেকে জিতিয়ে নিলেও শিরোপা-ভাগ্য এখনও নিজেদের হাতে জিনেদিন জিদানের দলের। বাকি পাঁচ ম্যাচ জিতলেই কারও উপর নির্ভর না করে ২০১২ সালের পর আবার চ্যাম্পিয়ন হবে রিয়াল। কিন্তু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে এমন হারের হতাশা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে বেশ বেগ পাওয়ার কথা মাদ্রিদের দলটির।