নগরীর গণপরিবহনে নারীদের যাতায়াত দিন দিন ‘দুর্বিষহ’ হয়ে উঠছে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে রীতিমতো ‘যুদ্ধ’ করতে হচ্ছে তাদের। নারী যাত্রীদের দেখে বাস হেলপাররা যেমন তুলতে চায় না, তেমনি পুরুষ যাত্রীরাও ‘নাক সিঁটকায়’। নারীদের দেখলেই হেলপাররা নিত্যনৈমিত্তিকভাবে বলে ওয়ে, ‘আপা সিট নাই’। আর ভেতর থেকে আওয়াজ ওঠে- ‘লেডিস তুলিস না’। এদিকে বাসে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলো দখল করে রাখে পুরুষরা। এ নিয়ে প্রায়ই বাদানুবাদ বাধে। এসব পুরুষ ও হেলপারদের হয়রানিতে বিপাকে রয়েছেন নারীরা।
রাজধানীর বিভিন্ন রুটের বাস ঘুরে এ চিত্রই বেরিয়ে এসেছে।
দেখা গেছে, প্রতিদিন অফিস শুরুর আগে ও ছুটির পরে বাসে নারীদের আসন পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। ব্যস্ততম ওই সময়ে নারী যাত্রীদের বাসের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে হয় পুরুষ যাত্রীর ধাক্কা খেয়ে। এমন ভিড় ঠেলে বাসে ওঠতে পারলেও আসন পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। বাধ্য হয়ে বসতে হয় ইঞ্জিনের উপর।
তবে ভয়ংকর চিত্র দেখা যায় রাতে চলাচল করা বাসগুলোতে। সিটিং বাস সার্ভিস হোক কিংবা লোকাল, রাত সাড়ে ৮টার পর কোনো বাস যাত্রীতে বোঝাই হলে তখন সেই বাসে নারীদের ওঠানো হয় না।
মিরপুরের বাসিন্দা রায়হানা আক্তারা রুমা অফিস করেন মতিঝিলে। প্রতিদিন বাসের ভিড় ঠেলে তাকে অফিস করতে হয়। নিউজবাংলাদেশকে তিনি বলেন, “আসন পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। প্রায়ই বাসে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় কোনো না কোনো নারীকে। আমাদের জন্য রাখা আসনগুলোতে পুরুষ যাত্রীরা বসে থাকে। তাদের অনুরোধ করেও তোলা যায় না।”
নারী যাত্রীদের অভিযোগ, অধিকাংশ সময়ে রাতে নারী যাত্রী স্থান পায় না গণপরিবহনে। পাশাপাশি রাজধানীর বাসে সর্বোচ্চ নয়টি সংরক্ষিত আসন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখার নির্দেশনা দেয়া আছে। সংরক্ষিত আসন নারীদের জন্য পর্যাপ্ত নয়।
এ প্রসঙ্গে তুরাগ পরিবহনের একটি বাসের হেলপার রুবেল বলেন, “রাতের বেলা নারীদের না নেয়ার কারণ আছে। লেডিস সিটে একসঙ্গে পাঁচজন যাত্রী বসতে পারে। আর রাতে পাঁচজন নারী যাত্রী পাওয়া যায় না। রাতে একজন নারী যাত্রী যদি নির্দিষ্ট সিটে বসে, তাহলে বড়জোর সেখানে তিনজন পুরুষ যাত্রী বসানো যায়। এতে একজনের ভাড়া কমে যায়। আবার রাতে নারী যাত্রী তুললে পুরুষ যাত্রীরা ঝামেলা করে।
যাত্রাবাড়ী থেকে পল্টন যেতে বাসের জন্য অপেক্ষারত ব্যাংক কর্মকর্তা শিরিন অক্তার নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “ভিড়ের কারণে বাসে উঠতে কষ্টসাধ্য। ব্যাংকে সময়মতো যেতে হবে, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও বাসে উঠতে পারলাম না। কারণ বাসে মহিলা সিট খালি নেই। দাড়িয়ে যেতে চাইলে হেলপার বলে, আপা ঝামেলা কইরেন না।”
এসব কারণে এখন বাধ্য হয়ে ১৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা করে যেতে হচ্ছে তাকে, যেখানে বাসের ভাড়া মাত্র পাঁচ টাকা।
গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী ৮ নম্বর রুটের বাসের চালক আজিজের ভাষ্যমতে, তাদের বাসে প্রচুর যাত্রী চলাচল করে। পুরো বাসে নারীসহ সংরক্ষিত আসন পাঁচটা। সাধারণ যাত্রীদের পাশাপাশি নারী যাত্রী রয়েছে। তাই নারী আসন খালি না থাকলে তারা নারী যাত্রী তোলেন না।
তিনি আরও বলেন, “লেডিস সিট এখন রোজকার বিবাদ আর কলহের কারণ। প্রায় প্রতি ট্রিপেই লেডিস সিট নিয়ে কোনো না কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়। তাই লেডিস সিট মানে উটকো এক ঝামেলা।”
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরীজীবী নাবিলা স্বপ্ন বলেন, “কর্মজীবী নারীরা যেন দেশের বোঝা। অফিস সময়ে বাসে সিট না পাওয়া সাধারণ ঘটনা। আবার বাসে দাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগও নেই। ওঠার আগে বাস হেলপাররা বলেন মহিলা উঠবেন না, লেডিস সিট নেই।”
বীমা কর্মকর্তা রীনা বাণী সাহা বলেন, “কর্মজীবী নারীদের ভোগান্তি কমাতে বিআরটিসির ‘মহিলা বাস সার্ভিস’ পর্যাপ্ত নয়। তাই বাধ্য হয়েই অন্য গণপরিবহনে ওঠার যুদ্ধ করতে হচ্ছে আমাদের। এতে অনেক হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। সঙ্গে যৌন হয়রানি তো আছেই।”
নিজের একটি ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, “কদিন আগে আমি রাত সাড়ে ৮টায় ধানমণ্ডি পুপলার হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গুলিস্থানের উদেশ্যে রওনা হই। সায়েন্স ল্যাব থেকে ট্রান্সসিলভা বাসে উঠি। বাসটির নারী সিটগুলো তখন পুরুষদের দখলে। হেলপার নারীদের আসন ছেড়ে দেয়ার জন্য একজনকে অনুরোধ করেন। কিন্তু কেউ তার কথায় কান দিচ্ছে না। এক পর্যায়ে পাশে থাকা পুরুষ যাত্রী নানাভাবে হয়রানির চেষ্টা করে। বাধ্য হয়ে আমি গন্তব্যের আগেই পল্টনে নেমে পড়ি।”
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) একজন কর্মকর্তা বলেন, “অফিস টাইমের আগে এবং পরে গণপরিবহনে সংরক্ষিত নারী সিটের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় আনা খুব জরুরি। অন্যদিকে গণপরিবহনে নারীর ভোগান্তি লাঘবে পুরুষরা যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন তাহলে নারীদের যাতায়াতের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে।”